সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

কেন মমি পঁচেনা? কি এই মমি।।BDNews.in


আব্দুল্লাহ আল বিন শাওন, বিশেষ প্রতিনিধিঃ সহজ ভাষায় হলতে গেলে মমি হল মৃতদেহ সংরক্ষণ করার বিশেষ এক পদ্ধতি। মমি কথাটি আরবি শব্দ ‘মামিয়া’ থেকে এসেছে, যার অর্থ মোম। মূলত মোম দিয়ে মৃতদেহকে আবৃত করা হতো, সেজন্য এর নামকরণ করা হয় মমি। প্রাচীন মিশরে বিশ্বাস করা হত যে, মৃত্যুর পর মানুষ আরেক পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই যাত্রা শেষে পরকালে বসবাসের জন্য তাদের দেহ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আর এই ধারণা থেকে তারা মমি বানানো শুরু করে। মিশরীয়রা শুধু মানুষ নয়, তাদের প্রিয় প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল এদের মৃতদেহকেও মমি বানিয়ে রাখতো।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে মমি করে মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। ইনকা, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, প্রাচীন ইউরোপিয়ান সভ্যতা সহ আরও অনেক সভ্যতায় মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছর ধরে মমিকরণ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিশর। তবে গ্রহণযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতারও এক হাজার বছর পূর্বে উত্তর চিলি এবং দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমির সংস্কৃতি চালু হয়।

এক এক সংস্কৃতিতে এক এক রকম ছিলো। ধারনা করা হয়, কোন কোন রীতিতে পুরো শহরের বাসিন্দাদের মমিকরণ করা হত। সেখানে ধনী আর গরিবের কোনো ভেদাভেদ ছিলো না। আর অন্যান্য রীতিতে মমিকরণ করা হত সমাজের ধনী এবং উচ্চবর্গীয় মানুষদের মৃতদেহ। যেহেতু বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া চরম তাপমাত্রায় বাড়তে পারেনা, সেহেতু মৃতদেহকে সূর্যের প্রচণ্ড তাপমাত্রায় রেখে বা হিমায়িত করার মাধ্যমে যে মমিকরণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হত তা অনেকটাই অসম্পূর্ণ একটি প্রক্রিয়া ছিল।

মমি গুলো সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।

১। এন্থ্রোপজেনিক মমি এবং

২। স্পন্টেনিয়াস মমি।

এন্থ্রোপজেনিক_মমি---- বলতে সেই মমিগুলোকে বুঝায় যেগুলোকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হত। সাধারণত ধর্মীয় কারণে এই ধরনের মমি বানানো হত। যেগুলো আমরা দেখতে পাই মিশরীয় সভ্যতায়।

স্পন্টেনিয়াস_মমি --তৈরি হত প্রাকৃতিক ভাবে, প্রচণ্ড গরম বা তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে অথবা বদ্ধ কোন জলাভূমির মত বায়ু শূন্য অবস্থায়। অধিকাংশ মমি ১ম ধরনের অন্তর্ভুক্ত।

মৃতদেহের ইচ্ছাকৃত মমিকরণ প্রথার চল শুরু হয় মিশরে ২য় রাজশাসন (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ সাল) চলাকালীন সময়ে। ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ম্যাকারি ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড এর ১১ বছরের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, অনুমান করা সময়েরও প্রায় ১,৫০০ বছর আগে থেকে মমিকরণের প্রথা চালু হয়। মিশরের মমির উপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। সেই প্রাচীন মিশরের লাশ মমি করে রাখার ব্যাপারটা ছিল একটা শৈল্পিক পর্যায়ের কেমিস্ট্রির খেলা। একটা লাশ মমি করতে কমপক্ষে ৭০ দিন সময় লাগতো।

কেন মমি পঁচতো না/পঁচে না?

মমিফিকেশন:-

মমিকরণের প্রধান হিসেবে থকতেন একজন পুরোহিত। তিনি মুখে আনুবিশের মুখোশ পড়ে থাকতেন। আনুবিশ হলেন মিশরীয়দের মৃত্যুদেবতা যার মুখ শেয়ালের মুখের মত । মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিলো মমিকরণের সাথে আনুবিশ দেবতা জড়িত ছিলেন। তাই মমি করার সময় পুরোহিতরা আনুবিশের মুখোশ পড়ে থাকতো। মমি তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হয় মমিফিকেশন।

প্রাক রাজবংশের সময়কাল (5000BC - 3000BC)  এর সময়কার কিছু জাতি (যেমন: বাদারিয়ান ও নাকাদান) যাদের মিশরীয় আদি পুরুষ বলা হতো তখনকার সময় থেকেই মমিফিকেশন প্রক্রিয়া চলছে । যদিও তখন তা এতো আধুনিক ছিলো না । তারা মায়ের পেটের ভ্রূন যেভাবে থাকে সেইভাবে মৃতদেহকে মরুভুমিতে সমাহিত করতো । মরুভুমির শুষ্ক আবহাওয়া আর উত্তাপ সমস্ত মৃতদেহ থেকে আর্দ্রতা শুষে নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে মমি তৈরী করে ফেলতো । পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া আরো আধুনিক হয় । সেই আধুনিক মিশরীয় রীতিটাই আজ আমরা জানতে চলেছি!

পুরো মমিফিকেশন প্রক্রিয়াকে দুইভাগে ভাগ করা যায় ।

১. Embalming বা যত্নসহকারে ও সুগন্ধীর দ্বারা দেহকে পরিষ্কার করা

২. Wrapping & Burial বা দেহকে দামী কাপড়‌ দিয়ে মুড়িয়ে সমাধিস্ত করা 

১. প্রথমত মৃতদেহকে একটা তাবুতে নিয়ে যাওয়া হয় যার নাম “ইবু” (Ibu) যার অর্থ “পরিষ্কার পরিছন্ন হবার স্থান” । সেখানে গিয়ে Embalmers বা যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তারা নিজেদের হাত সুগন্ধীযুক্ত তালের ওয়াইন এ ডুবিয়ে নেয় এবং তা নীলের পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করে নেয় ।

২. একজন Embalmers দেহের বামদিকের অংশ কেটে ফেলে বেশ‌কিছু গুরুত্বপুর্ন অঙ্গ বের করে আনে । এটা খুবই গুরুত্বপুর্ন কাজ । এতে দেহ পঁচে যাওয়া থেকে রক্ষা পায় । কারন এই অঙ্গগুলোই‌ সর্বপ্রথম পঁচা শুরু করে একটি মৃতদেহে। পাকস্থলী, যকৃত, ফুসফুস এবং নাড়ীভুড়ি বের করে একজন এসব ধৌত করে এবং Natron নামক একধরনের প্রাকৃতিক লবন দ্বারা এগুলোকে বেঁধে রেখে শুষ্ক করে ফেলা হয়। কিন্তু তারা হার্ট বা হৃদপিন্ডকে দেহেই রেখে দিতো । কারন তারা বিশ্বাস করতো-এই হৃদপিন্ড হচ্ছে সকল জ্ঞান আর অনুভুতির আধার যা মৃতদেহকে পরবর্তী জীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করাবে।

৩. এক ধরনের লম্বা হুকের মতো চামচ দ্বারা ঘিলু ফাটিয়ে মগজ নাক দিয়ে বের করে নিয়ে আসা হতো।

৪. পুরো দেহ Natron নামক একধরনের লবনে ৪০ দিন অব্দি ডুবিয়ে রাখা হয় যা দেহের আর্দ্রতা শুষে‌ নিয়ে যাবে, সেই সাথে দেহকে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণু মেরে ফেলবে এবং এই প্রক্রিয়ার ব্যাবহৃত সব তরল ও নেকড়াও সংরক্ষন করে রাখা হয় যা পরবর্তীতে মৃত দেহের সাথে তার সমাধিস্ত করা হবে।

৫. ৪০‌দিন পর দেহকে লবনের ভেতর থেকে বের করে ধৌত করা হয় । এবং পুরো দেহে বিশেষ ধরনের তেল মাখিয়ে দেয়া হয় যাতে দেহের মসৃনতা ফিরে পায় এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায় 

৬. পুরো শুষ্ক দেহের ভেতর এবার আগেই শুকিয়ে রাখা কিছু অঙ্গপ্রতঙ্গ লিনেন কাপড়ে মুড়িয়ে দেহের যে স্থানে ছিলো সেই‌ স্থানে রেখে দেয়া হয় (৪টা অঙ্গ -

পাকস্থলী, যকৃত, ফুসফুস এবং নাড়ীভুড়ি বাদে)। তারপর দেহের ভেতর কাঠের গুড়ো, শুকনা পাতা আর লিনেন কাপড় ভরে মৃতদেহের বাস্তবের জীবনের চেহারা ফিরিয়ে দেয়া হয়।

৭. আরেকবার সুগন্ধী তেল সম্পুর্ন ‌দেহে মাখিয়ে দেয়া হয় । দেহের চাকচিক্য ফিরিয়ে আনা হয় । পুরো অংশের পুরো প্রক্রিয়ায় আনুমানিক সময় ৪৫-৫৫ দিন যায় । এবার দেহ Wrapping বা মুড়িয়ে দেয়ার জন্য সম্পুর্ন রূপে‌ প্রস্তুত কিন্তু সেই অংশে যাবার আগে আরো কিছু ব্যাপার জানিয়ে দেই। মমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় সব অঙ্গ Natron এ শুকিয়ে দেহে ফেরত পাঠানো হলেও ৪ টা ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গ দেহে ফেরত পাঠানো হয় না । এই‌ ৪ টা গুরুত্বপুর্ন অঙ্গ, মিশরীয়দের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা হোরাসের ৪ ছেলে রক্ষা করে। এই ৪ টা অঙ্গ যে কাঠের বা পাথরের পাত্রে রাখা হয় তাকে বলে “Canopic Jar”; এই‌ জারগুলো মমির সাথেই সমাধিস্ত করা হয়!

শেষ কথা মিশরীয়দের প্রাচীন বিশ্বাস ও তাদের বুদ্ধি থাকলেও তাদের সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান ছিলোনা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ