জায়গাটা ছিল বেশ নির্জন!
কিছু হিন্দু ধর্মের মানুষ এসে কালির থানে পূজো দিয়ে সেই সন্ন্যাসীকে কলাপাতায় মুড়ে খাবার দিয়ে যেতো!!
খাবার গুলো ছিল বাতাসা,সন্দেশ,কদমা,চিনির গজা,কেশুর, জিলাপি আর বিভিন্ন ফলমূল!
সবাই যখন পুজো দিয়ে চলে যেতো,তখন সন্ন্যাসী আমাকে ডেকে আগে আমার মুখে খাবার তুলে দিতেন,তারপরে তিনি খেতেন!
উনি বলতেন," তুই তো আমার অতিথি,আমার নারায়ণ তোকে আগে না খাইয়ে তো আমি খেতে পারবোনা মা"!
সেই সন্ন্যাসীই আমাকে 'ছোট্ট পরী' ডাকতেন! তিনি নাকি আমার ভেতর অন্য কিছু দেখতে পেতেন! কি দেখতে পেতেন কখনও তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়নি! এখন আফসোস হয় কেন জিজ্ঞেস করিনি!
উনি কিন্তু জানতেন আমি মুসলমান ঘরের কন্যা!
যারা ওখানে পূজো দিতে আসতেন তারা আমার জাত শুনে দশহাত দূরে সরে যেতো! অথচ যাকে পূজোর খাবার নিবেদন করতেন সেই মানুষটাই আগে আমার মুখে খাবার তুলে দিয়ে তবেই তিনি খেতেন!
এখন আমার কথা বলি!
চমৎকার একটা কবিতা লিখেছিলাম নাটোরে বসে।
তখন বই খাতা বাদ দিয়ে কবিতায় আনন্দ খুঁজি। সে এক অদ্ভুত সময় আমার জীবনে!
তবে আমি কবি হব না এতটুকু জানতাম!
ভেতরের কথাগুলো কারো কাছে বলে নির্ভার হতে পারিনা, আবার এমন ভাবনাও আসে, ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি আর লিখতে পারছি না! তখন কি হবে?
সেই ওলট-পালোট সময়েই বেড়াতে গেছি বোনের বাড়ী নাটোরে! দূর্গার মতো আমারও শখ রেলের রাস্তা দেখবার! কে নিয়ে যাবে? আব্বা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই দেখতে নিয়ে যেতো!
মজার কথা হল রেলে করেই নাটোর যেতে হতো! কিন্তু রেল থেকে নেমেই বোনের বাড়ী রওনা! রেলের রাস্তা আর দেখা হতো না ভালো করে!
নাটোরের মিরপাড়ার আশেপাশে একা-একা ছোট্ট পরী ঘুরে বেড়ায়! ছোট্ট এক চিলতে শহর। এখনও ফিরে তাকালে টুকরো কিছু দৃশ্য চোখে ভাসে!
হাইকোর্টের ভেতর ঘুরতে গিয়ে একজন ফর্সা টুকটুকে লাল চুলের মহিলা আমাকে বলে, "তুমি আনুর শালী না"?
দুলাভাই এর নাম আনু জানিনা! দুলাভাই এর ছোট ভাইএর নাম তাজু!সেটা জানি! কারণ তাজু ভাইয়ের সাথেই ছোট্ট পরীর বেশী খাতির যে!
আমি বীরদর্পে বললাম,আনু কে? তাকে তো চিনিনা আমি তাজু ভাইয়ের বোন!
মহিলা খুব গম্ভীর ভাবে বললেন,"আমি আনু/তাজুর বড় বোন দুলু তুমি আমাকে চিনতে পারছো না কেন?"
আমি অবাক!
কারণ বাসায় দুলু আপাকে যখন এক চিলতে দেখেছি তখন তার মুখে একটাও দাঁত ছিলনা!
তিনি এখন মুখে নকল দুই পাটি দাঁত লাগিয়েছেন!
দাঁত ওয়ালা দুলু আপাকে চিনবো কেমনে? আমি তো দাঁত বিহীন দুলু আপাকে চিনি!
একদিন তাজু ভাইয়ের ঘরে পেয়ে গেলাম জয় গোস্বামীর কবিতার বই!ততক্ষনে পাগলী তোর সঙ্গে, ঈশ্বর ও প্রেমিকার কথোপকথন, যদি মেঘ থেকে নামে মৃত্যু সকল গাছ ...হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা শুরু করেছি।
নাটরে বসে গভীর এক শীতের রাতে চুপিচুপি লিখে ফেলি-
চমৎকার একটা কবিতা!
কাগজ কই পাবো? একটা পেনসিল যোগার করেছি কোন রকমে! শেষে পেনসিল দিয়ে জয় গোস্বামীর বই এর একটা সাদা পাতায় কবিতাটা লিখে ফেলি!
লিখে অদ্ভুত অনুভুতি হয়!
ভাবি এত সুন্দর লিখেছি? জয় গোস্বামীর বইটা লেপের নীচে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাই!
বইটা নাটরে ফেলে বাড়ী চলে যাই!পরে আর পাইনি! অনেক খুঁজেছি!
এখন চোখ বন্ধ করে 'ছোট্ট পরীর' কথা ভাবি!
যে পরীর চোখে সেই সন্ন্যাসী দেখতো অপাপবিদ্ধ শৈশব!
পরীর চারপাশে অনেক পাখি,প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে আপনজন হয়ে, আর ও খুশিতে হাসছে এমন দৃশ্য কল্পনা করি।
বছর চলে যায় ছোট্ট পরী সময়ের নিয়মে বড় হয়ে ওঠে। এখন আয়না তাকে বয়সের ত্রিকোনোমিতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
মানুষের ভালোবাসা, অহম,স্বার্থপরতা,একইসাথে মমতা আর স্নেহ- এই সব অনুভূতির পরশে আমি নির্লিপ্ত হয়ে আড়াল থেকে আরো অন্তরালে চলে যাই।
আমার খুব ইচ্ছে করে সেই আমাকে-সেই ছোট্ট পরীকে খুঁজি-খুঁজে পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলি,
'ছোট্ট পরী, চল তোকে তোর শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তুই নির্ভার শৈশবে আবার ছুটে বেড়াবি, আর পাখি,প্রজাপতি তোর আপনজন হয়ে আকাশ থেকে নেমে আসবে!
তোকে তোর সেই অপূর্ব শৈশবে ফিরিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসবো। নিজের ভুলগুলোকেও রেখে আসব হয়ত। ফিরে আসবো অনেক বৈষয়িক হয়ে! তখন আর কোন কিছুতেই মন খারাপ করবো না!
আমি মন খারাপ করে অন্য কিছু লিখবার চেষ্টা করি!
ছোট্ট পরীর জন্য,জয় গোস্বামির বইয়ের সেই সাদা পাতার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে!
লেখকঃ কাঁকন কাজী
0 মন্তব্যসমূহ