সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

শেষ জীবনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার।।BDNews.in


বিডি নিউজ ডেস্কঃ ঢাকার মিরপুরে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করেন শরিফুল ইসলাম। মাস শেষে যে বেতন পান, মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ঘাটতি থেকে যায়। ফলে কয়েক মাস ধরে সঞ্চয় থাকে না অর্থ। বললেন, এভাবে চলতে থাকলে শেষ জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা কে দেবে? শেওড়াপাড়া বাজারের ইলেকট্রনিক ব্যবসায়ী ইফতেখারও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। বললেন, ব্যাংক অথবা কোনো সমিতিতে টাকা জমা রাখার উপায় থাকে না। কারণ ব্যয় বেশি। কিন্তু সঞ্চয় করা তো দরকার।

হ্যাঁ, শেষ জীবনে মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। সে জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শুরু হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম। চারটি স্কিমে জমা রাখা যাবে অর্থ। অতিদরিদ্র থেকে শুরু করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষ এই স্কিমে যুক্ত হতে পারবেন। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে নিয়োজিত এবং প্রবাসীরাও পাবেন সুবিধা। মাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা রাখতে হবে। ৬০ বছর পর যে টাকা জমা হবে, তার সঙ্গে যোগ করে মাসিক ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধ করবে সরকার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পেনশনব্যবস্থা সরকারের ভালো উদ্যোগ। তবে তদারকির জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। মানুষের জমা রাখা অর্থের যাতে সঠিক ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সমাজের উচ্চবিত্তদের জন্য নানা রকম সুবিধা আছে। কিন্তু নিম্নবিত্তদের জন্য তেমন সুবিধা নেই। পেনশনব্যবস্থা চালু হলে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী বাংলাদেশি প্রত্যেক নাগরিক চারটি স্কিমে যোগ দিতে পারবেন। অতিদরিদ্রদের জন্য ‘সমতা’, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, কর্মচারীদের জন্য ‘প্রগতি’ এবং প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস’ স্কিম। উদ্বোধনের দিন থেকেই চালু হবে পুরো কার্যক্রম। ৫০ বছরের বেশি ব্যক্তিরাও এসব স্কিম নিতে পারবেন, তবে ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দেয়ার পর তারা পেনশন পেতে শুরু করবেন। যদি ১০ বছরের আগে পেনশনার মারা যান, সে ক্ষেত্রে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। যদি পেনশনভোগী ৭৫ বছরের আগে মারা যান, তাহলে তার নমিনি সেই বয়স পর্যন্ত একই হারে পাবেন পেনশন সুবিধা।

আপাতত সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ পেনশন স্কিমের আওতাবহির্ভূত থাকবেন। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকদের এ ব্যবস্থায় রাখা হবে না। তবে সর্বজনীন নিরাপত্তাবলয়ের সুবিধাভোগী কেউ তার এসব সুবিধা সমর্পণ করে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।


সমতা

সমতা কর্মসূচিটি হচ্ছে স্বকর্মে নিয়োজিত অতিদরিদ্র নাগরিকের স্কিম। অর্থাৎ এ কর্মসূচি নিম্নআয়ের মানুষের জন্য, যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘হাউসহোল্ড ইনকাম এক্সপেনডিচার সার্ভে’ অনুসারে যারা অতিদরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন, যাদের নিজস্ব আয় দিয়ে জীবন ধারণের ন্যূনতম উপকরণ জোগাড় করতে পারেন না, এ শ্রেণির মানুষ নির্ধারিত হারে চাঁদা দিয়ে এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন।

সমতা পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের মাসিক চাঁদার অর্ধেক দেবে সরকার। কর্মসূচির আওতায় একজন অংশগ্রহণকারীকে মাসে দিতে হবে ৫০০ টাকা, এর বিপরীতে সরকার দেবে আরও ৫০০ টাকা। এভাবে কেউ যদি ৪২ বছর ১ হাজার টাকা করে জমা দেন, তাহলে মেয়াদ শেষে তিনি মাসে পেনশন পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে।


সুরক্ষা

এটি রিকশাচালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ অনানুষ্ঠানিক খাত বা স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য। এখানে মাসিক চাঁদার হার ১ হাজার, ২ হাজার, ৩ হাজার এবং ৫ হাজার টাকা। সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায়ও ১৮ বছর বয়সীরা কেউ যদি ৫ হাজার টাকা করে মাসে জমা দিয়ে পেনশনে যুক্ত হন, তাহলে ৪২ বছর শেষে তিনিও মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন। মাসে ৩ হাজার টাকা জমা দিলে ৪২ বছরে একজন পাবেন ১ লাখ ৩ হাজার ৩৯৬ টাকা। ২ হাজার টাকা করে জমা হলে ৪২ বছরে পেনশনার পাবেন ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা। আর ১ হাজার করে জমা হলে পাবেন ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা।


প্রগতি

এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা কর্মচারীদের জন্য। প্রচলিত আইনের আওতায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি বা কর্মচারী কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিক নির্ধারিত হারে চাঁদা জমা দিয়ে এ স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের কর্মচারীদের এ স্কিমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে চাঁদার হার ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক কর্মী আর বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান দেবে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ স্কিমে অংশ না নিলেও প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারী এককভাবে অংশ নিতে পারবেন।

এই স্কিমে চাঁদার হার ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। কেউ যদি ৫ হাজার টাকা করে মাসে জমা দিয়ে পেনশনে যুক্ত হন, তাহলে ৪২ বছর শেষে তিনিও মাসে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে পাবেন। মাসে ৩ হাজার টাকা জমা দিলে ৪২ বছরে একজন মাসিক পাবেন ১ লাখ ৩ হাজার ৩৯৬ টাকা। ২ হাজার টাকা করে জমা হলে ৪২ বছরে পেনশনার মাসে পাবেন ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা।


প্রবাস

এই কর্মসূচি প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য। বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক তার ইচ্ছা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধের শর্তে নির্ধারিত হারে চাঁদা পরিশোধ করে এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। প্রবাস থেকে দেশে ফেরার পর সমপরিমাণ অর্থ দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধসহ প্রয়োজনে স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন। স্কিমের মেয়াদ পূর্তি হলে পেনশনার দেশীয় মুদ্রায় তার পেনশন পাবেন। এ স্কিমে প্রতি মাসে তিন ধরনের চাঁদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা।

১৮ বছর বয়সী একজন প্রবাসী যদি মাসে ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন, তবে ৪২ বছর পর তিনি মাসে পাবেন ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা করে। আবার ১৮ বছর বয়সী বেসরকারি কোনো চাকরিজীবী যদি মাসে সাড়ে ৭ হাজার জমা দেন, ৪২ বছরে তিনি মাসিক পাবেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯১ টাকা। আর ৫ হাজার টাকা করে জমা দেন, তাহলে তিনি ৪২ বছর পর মাসে পাবেন ১ লাখ ৭২ হাজার ৩২৭ টাকা করে।


কত গুণ পাওয়া যাবে

১৮ বছর বয়স থেকে ৪২ বছর ধরে কেউ মাসে ১ হাজার টাকা জমা করলে ৬০ বছর পর্যন্ত মোট জমা হবে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পরবর্তী ১৫ বছর অর্থাৎ ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন হিসেবে মাসে দেয়া হবে ৩৪ হাজার ৪৬৫ টাকা করে। ১৫ বছরে সরকার একজনকে দেবে ৬২ লাখ ৩ হাজার ৭০০ টাকা। অর্থাৎ জমা দেয়া অর্থের ১২ গুণের বেশি অর্থ ফেরত দেবে সরকার। এভাবে প্রতিটি স্কিমে অর্থ ফেরতের সুযোগ রয়েছে।


যেভাবে নিবন্ধন

একজন ব্যক্তিকে পেনশন স্কিমে যুক্ত হতে হলে তার থাকবে ১৮ ডিজিটের ইউনিক নম্বর। ইউপেনশন ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রমাণপত্র হিসেবে প্রয়োজন হবে জাতীয় পরিচয়পত্র। এ ছাড়া পাসপোর্টও দরকার হবে। চাঁদা জমার ক্ষেত্রে অনলাইন, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক হিসাবের আশ্রয় নেয়া যাবে। যদি কেউ চাঁদা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে দ্বিতীয় মাস থেকে জরিমানা করা হবে। মোট জমার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নেয়া যাবে ঋণ।


এক বা একাধিক নমিনি মনোনয়ন

বিধিমালায় বলা হয়েছে, পেনশনার মারা গেলে অর্থ কে পাবেন, সে জন্য চাঁদাদাতা এক বা একাধিক নমিনি মনোনয়ন করতে পারবেন। পাশাপাশি যেকোনো সময় একজন বা সব নমিনিই পরিবর্তন করে নতুন নমিনি মনোনয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে।

পেনশনধারী মারা গেলে এবং তার মৃত্যুর পর নমিনি মনোনয়ন কার্যকর থাকলে পেনশনের অর্থ নমিনি পাবেন। তবে নমিনি যদি নাবালক হয়, সে ক্ষেত্রে পেনশনধারীর মৃত্যুর পর নমিনি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত নমিনির পক্ষে অর্থ তুলতে পারবেন চাঁদাদাতার মনোনয়ন বা নিয়োগ দেয়া যেকোনো ব্যক্তি। তিনিই হবেন নাবালক নমিনির আইনসম্মত অভিভাবক। নমিনি সাবালক না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তি নাবালক নমিনির প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হবেন।

একাধিক নমিনির ব্যাপারে বলা হয়েছে, কোনো স্কিমের বিপরীতে একাধিক নমিনি থাকলে এবং যেকোনো একজন নমিনি মারা গেলে এবং মৃত নমিনির বিপরীতে নতুন কোনো নমিনি মনোনয়ন না করা হলে জীবিত নমিনি বা নমিনিরা ওই স্কিমে উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হবেন। তারা ওই স্কিমের অর্থ পাবেন।

পেনশনার মাসিক পেনশন পাওয়ার উপযুক্ত হওয়ার আগেই মারা গেলে তার নমিনি বা নমিনিরা অথবা নমিনির অবর্তমানে উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারীরা মুনাফাসহ জমা করা অর্থ ফেরত পাবেন। নমিনির অবর্তমানে উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারের সনদ বিবেচনা করবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অর্থসচিব বরাবর আপিল করার সুযোগ পাবেন। আপিল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।


আজ উদ্বোধন

বহুপ্রতীক্ষিত এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ভার্চুয়ালি এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন তিনি। সার্বিক বিষয় তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে সার্বিক দিক প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা হবে।


অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুশ্চিন্তা

অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, জনগণের কাছ থেকে নেয়া অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য দেয়া হলেও তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। তিনি বলেন, এই অর্থ যদি ইচ্ছামতো ব্যবহার হয়, তাহলে পরিশোধের সময় সরকারের দায় বাড়বে। এতে বড় ধরনের বিপদ তৈরি হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এমন উদ্যোগ দেখা যায়। আমাদের দেশের মানুষদের জন্য সরকার সাহসী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এর ফলে শেষ জীবনে আর্থিক সুরক্ষাবলয়ে থাকবে কোটি কোটি মানুষ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ