সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

ইতিহাসে একেবারে বাঙালি হয়েই জায়গা করে নিয়েছে সুইস জুতো বাটা।।BDNews.in


বিডি নিউজ ডেস্কঃ বাঙালি অথচ খাদিম বা বাটার (Bata) জুতো পায়ে গলাননি, এমন বোধহয় বহু খুঁজে মিলবে। ১৮৯৪ সালের কথা। সদ্য বেরিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’। মধ্য ইউরোপে বরফঢাকা আল্পসের এপার-ওপার জুড়ে তখন রাজত্ব করছে বিখ্যাত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য। আজকে যেখানে চেক প্রজাতন্ত্র, এককালে তারই নাম ছিল মোরাভিয়া। তার এক ছোট্ট শহর জিন, একেবারেই গঞ্জের মত। সেখানে একটি জুতোর দোকান খোলে তিন ভাইবোন। বড়ভাই টমাস বাটা, তার দুই ভাইবোন, আঁতোয়া ও অ্যান। জাতে চেক। পারিবারিক সূত্রেই তাদের চামড়ার ব্যবসা ছিল। অবস্থা যদিও সুবিধের ছিল না। হাতে সম্বল ছিল মায়ের দেওয়া আটশো গাল্ডেন, অস্ট্রিয়ার সেকালের মুদ্রা।

কিন্তু শুরু থেকেই উদ্ভাবনীর দিকে জোর দিয়েছিলেন তাঁরা। মাত্র জনাদশেক কর্মী ছিল। কিন্তু চামড়ার বদলে ক্যানভাস দিয়ে জুতো বানানো শুরু করেন টমাস। বেজায় জনপ্রিয় হয়েছিল সেই জুতো। ব্যবসা বাড়তে শুরু করল। উৎপাদন বাড়াতে টমাস নিয়ে এলেন মেশিন। কীভাবে আরও উন্নত মেশিন নিয়ে আসা যায় জানতে জাহাজে চড়ে আমেরিকার বস্টন থেকেও ঘুরে এলেন তিনি। ফল মিলেছিল হাতেনাতে। ১৯০৪ সালের মধ্যেই বাটার জুতোর (Bata) উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াল প্রতিদিন ২২০০ জোড়া জুতো। ১৯১২ সালের মধ্যে কর্মী বেড়ে দাঁড়াল ৬০০ জনে।

ততদিনে ইউরোপের রাজনীতির আকাশে ছেয়ে আসছে যুদ্ধের কালো মেঘ। একদিকে প্রুশিয়ার উত্থান, অন্যদিকে বলকান জাতীয়তাবাদের মাথাচাড়া দেওয়া, মাঝে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টালমাটাল দশা। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারাজেভো শহরে অস্ট্রেলিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যার পরে গোটা বসনিয়া জুড়ে যেন আগুন জ্বলে উঠল। তারপর একে একে গোটা ইউরোপ গ্রাস করা সেই বিধ্বংসী আগুনের নাম ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’। সৈনিকদের মধ্যে ভাল জুতোর তীব্র চাহিদা দেখা দিল বাজারে। একধাক্কায় বাটার জুতোর বিক্রি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ব্যবসা ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পড়ল মধ্যপ্রাচ্যে, আমেরিকায়, এশিয়ায়।

১৯৩২ সালে সরকারিভাবে বাটা (Bata) পা রাখে ভারতে। তখনও ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী কলকাতা, তথা পূর্ব ভারত। বাটার প্রথম ফ্যাক্টরি খুলেছিল হুগলির তীরে, কোন্নগরে। দু’বছর পরে, ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে নদীর আরও দক্ষিণে, বন্দরের খুব কাছেই বিরাট জায়গা নিয়ে নতুন কারখানা শুরু করে বাটা। কার্যত সেই কারখানা ও তার বিক্রির টানেই হুড়মুড়িয়ে বেড়ে যায় জনসংখ্যা। ছোটখাটো একটা শহরই হয়ে যায় সেখানে। বাটার জুতোর (Bata) হাত ধরেই আজ যার নাম ‘বাটানগর’। এককালে এটিই ছিল এশিয়ার সবচেয়ে বড় জুতোর কারখানা।

বস্তুত, বিশ্বজুড়েই টমাস বাটার ‘স্ট্র্যাটেজি’ ছিল এরকমই (Bata) । ছোটখাটো গঞ্জ দেখে কারখানা খুলতেন, তারপর তাকে ঘিরে তৈরি হত শহর। নেদারল্যান্ডসের ‘বাটাডোর্প’, ফ্রান্সের ‘বাটাভিল’, কানাডার ‘বাটাওয়া’, ব্রাজিলের সাও পাওলোর কাছে ‘বাটাতুবা’ এমনকি পাকিস্তানেও রয়েছে ‘বাটাপুর’—সৌজন্যে বাটার জুতোর কারখানা।

‘বাটা’র এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ‘খাদিম’ বয়সে যদিও বাটার (Bata) চেয়ে অনেকটাই ছোট। তার ইতিহাস জুড়েও এত উপাদান নেই। একেবারে খাঁটি বাঙালির হাতে, এই শহর কলকাতায় তৈরি।

১৯৬৫ সালের কথা। চিৎপুরের এক জুতোর দোকানের নাম ছিল ‘কেএম খাদিম অ্যান্ড কোম্পানি’। সেই দোকান কিনে নিয়েছিলেন বাঙালি ব্যবসায়ী সত্যপ্রসাদ রায়বর্মণ। তবে শুরুতেই নামী ব্র্যান্ড বানানোর কথা ভাবেননি সত্যপ্রসাদ। ১৯৯৩ সাল অবধি ‘হোলসেল’ বিক্রির দিকেই নজর ছিল খাদিমের। ১৯৮১ সালের ৩ ডিসেম্বর ‘এস এন ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে কোম্পানি খুলেছিলেন তাঁরা। অথচ আজ খাদিমের ব্যবসা সারা দেশের জুতোর মধ্যে শীর্ষে, রাজস্ব ১৮০ কোটি টাকারও বেশি। ২৩ টি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জুড়ে ৮২৬ টিরও বেশি স্টোর রয়েছে তাদের।

খাদিমের জুতোর এই তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ কী? চলতি বাংলায়, সবার জন্য জুতো, সকলের পায়ে জুতো। দামে সস্তা, মানে ভাল। যা ভারতীয় জলহাওয়ায়, ভারতের রাস্তায় দিব্যি সবার পায়ে খাপ খেয়ে যেতে পারে। খাদিমের একটা সুবিধে, তারা বিভিন্ন দামের, বিভিন্ন স্তরের ক্রেতার জন্য আলাদা আলাদা ব্র্যান্ড বাজারে এনেছে। রয়েছে ‘ল্যাজার্ড’ বা ‘প্রো’-এর মত দামি ব্র্যান্ড, আবার ‘ক্যালিপ্সো’ বা ‘ওয়াশ অ্যান্ড ওয়্যার’-এর মত সবার নাগালে থাকা ব্র্যান্ডও।

একটি বিপণন পত্রিকাকে খাদিমের নম্রতা চোত্রানি বলেন, দেশের ৮৫ ভাগ জুতো বিক্রি হয় ১০০০ টাকার কম দামে। এমনকি বাকি সমস্ত জুতোর ব্র্যান্ডকে হিসেবে রাখলে দেখা যাবে, ৫০ ভাগের বেশি জুতো বিক্রি হয় ৫০০ টাকারও কম দামের। খাদিমের সবচেয়ে বড় সাফল্য, এই দামের মধ্যে ভাল মানের জুতো বানিয়ে বাকিদের টেক্কা দেওয়া। যেখানে জুতো চলবে বেশিদিন, পায়ে পরে আরাম থাকবে এবং সহজে জলে ধুয়েও ফেলা যাবে। তাই আট থেকে আশি, শহর থেকে এখন গ্রামেগঞ্জেও মানুষের কাছের জুতোর দোকান হয়ে উঠছে খাদিম।

২০০১ সালের ২৫ জুলাই খাদিমের অন্যতম কর্তা, সত্যপ্রসাদ রায়বর্মণের পুত্র পার্থ রায়বর্মণকে অপহরণ করা নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল বাংলায়। আজও পুলিশের নানা আলোচনায়, বিতর্কে উঠে আসে সেই বিখ্যাত ‘খাদিম কর্তা অপহরণ মামলা’। প্রথমে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়, পরে তা নেমে আসে ৫ কোটিতে। শেষে প্রায় সওয়া চার কোটিতে রাজি হয় অপহরণকারীরা। মুক্তি পান পার্থ। এদিকে তদন্তভার হাতে নেয় সিআইডি। জানা যায়, সেই অপহরণের টাকা ঘুরেছিল দুবাইয়ের অপরাধ জগতে, কাজে লাগানো হয়েছিল সন্ত্রাসমূলক কাজেও।

কোভিড ও তারপরের লকডাউনে জুতোর ব্যবসা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছিল বাজারে। বিশেষ করে বাটা (Bata) একেবারেই লাভের মুখ দেখেনি। কিন্তু কোভিডের পরে বাজার চাঙ্গা হতেই খাদিম এবং বাটা (Bata) দুই সংস্থারই বিক্রি আবার ক্রমশ চাঙ্গা হচ্ছে। সুইস ঘড়ি বা সুইস ব্যাঙ্ক সবার নাগালে না এলেও খাদিমের পাশাপাশি বাঙালির মননে, ইতিহাসে একেবারে বাঙালি হয়েই জায়গা করে নিয়েছে সুইস জুতো বাটা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ