ডিপ্রেশন এক প্রকারের মানসিক অসুস্থতা যেটা সাধারণত মানুষের মন খারাপ থেকে উৎপত্তি পারে হতে পারে বা অলস জীবন যাপনের কারণে হয়ে থাকে। দুই সপ্তাহ এর বেশি অর্থাৎ আপনি যদি ২০ দিন বা এর বেশি সময় ধরে মন খারাপ, কোন কাজে আগ্রহ পাচ্ছেন না, সব সময় ক্লান্ত লাগছে, এবং আপনার পছন্দের কাজগুলো থেকে আপনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, খুব বিরক্ত লাগছে, একা থাকতে ইচ্ছে ,করছে কারো সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারছেন না, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, নিজের ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করছে অথচ আপনি অপরাধের কোনো কাজই করেন নি, রাতে ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে না বা অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছেন, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে,এসমস্ত লক্ষণগুলো যদি আপনার ভিতরে ২০ দিনের বেশি সময় ধরে চলে থাকে তাহলে বুঝতে পারবেন যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন বা পড়েছেন।
ডিপ্রেশন কত ধরনের হয়?
ডিপ্রেশন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্রেশন এর ধরন ব্যাখ্যা করা হয়েছে,
মেজর ডিপ্রেশন: এটাকে মেডিকেলের ভাষায় মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার বলে থাকে। যদি দিনে আপনি সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকেন বা ডিপ্রেসড অবস্থায় থাকেন তাহলে এটিকে মেজর ডিপ্রেশন বলা হয়।
লক্ষণ সমূহ:
১ রাতে ঘুমের প্রচন্ড সমস্যা হবে এবং সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকবে।
২: ওজন কমতে থাকবে বা বাড়তে থাকবে।
৩: ভালোলাগার কাজগুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে যাবে।
৪: যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সমস্যা হবে।
৫: নিজেকে অর্থহীন মনে হবে এবং কোন কারন ছাড়াই একটা অপরাধবোধ কাজ করবে।
৬: মাঝে মাঝে আত্মহত্যার চিন্তা ও আসতে পারে
৭: মেজাজ খুব বেশি খিটখিটে থাকতে পারে।
প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার:
এই ধরনের ডিপ্রেশন দীর্ঘ সময় অর্থাৎ তাকে দুই বছর বা এর বেশি সময় ধরে যদি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত থাকেন তাহলে বুঝতে হবে এটা প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। এ ধরনের ডিপ্রেশন সাধারণত পারিবারিক বা সামাজিক কারণে বেশি হয়ে থাকে।তবে অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও হয়ে থাকে।
লক্ষণ সমূহ:
১: তীব্র অনিদ্রা দেখা যাবে বা অতিরিক্ত ঘুম হবে।
যারা অতিরিক্ত ঘুমান দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টা ঘুমাতে ইচ্ছে করে তাদের এই প্রিসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
২: কোন কারন ছাড়াই সব সময় মন খারাপ থাকবে।
৩: খাবার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে বা খুদা অতিরিক্ত বেড়ে যাবে।
৪: আত্মহত্যার পরিকল্পনা বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা।
৫: সব সময় ক্লান্ত অনুভব এবং কোন কাজে এনার্জি আসবে না।
৬:পছন্দের কাজগুলো থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা ও ব্যবহার ঠিক রাখতে না পারা এবং অতিরিক্ত দ্বিধায় থাকা।
৭: নিজেকে একদম অপদার্থ বা অর্থহীন মনে করা এবং প্রতিটা বিষয়ে আশাহত হওয়া।
৮: আত্মসম্মানবোধ কমে যাওয়া।
সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার:
বছরের কোন কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডিপ্রেস হয়ে যাওয়া। যেমন অনেকে শীতকালে ডিপ্রেসড হয়ে যায় দিন ছোট হয়ে আসা বা রাত বড় হয়ে যাওয়ার কারণে বা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে। এটি খুবই সাধারন পর্যায়ের একটি ডিপ্রেশন।
সাইকোটিক ডিপ্রেশন:
এ ধরনের ডিপ্রেশন সাধারণত কোন ঘটনা থেকে হয়ে থাকে। যেমন ধরুন কারো পছন্দের ব্যক্তি মারা গেল বা কারো সাথে খুব বাজে কোন দুর্ঘটনা হল, বা কেউ অত্যাধিক ভয় পেল, ইমোশনালি কষ্ট পেলে বা মানসিক ভাবে কোনো আঘাত পেলে, বা চোখের সামনে বড় কোনো দুর্ঘটনা দেখলে।
লক্ষণ সমূহ:
১: হ্যালুসিনেশন (এমন কিছু দেখা শোনা বা অনুভব কর যেটার কোনো অস্তিত্ব নেই)
২: বিভ্রান্তি (কোন কিছুতে ভুল বিশ্বাস থাকা)।
৩: মস্তিষ্কবিকৃতি (সব সময় বা মাঝে মাঝে এরকম অনুভব হতে থাকবে যে কেউ তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করছে বা ক্ষতি করতে চাচ্ছে)।
৪: দুঃস্বপ্ন।
৫: সবকিছুতেই প্রচন্ড ভয় পাওয়া বা ভয় পেতে থাকা।
ট্রিপিক্যাল বা সাধারণ ডিপ্রেশন:
এটি সাধারণত মানুষের ক্রমাগত মন খারাপ থাকার কারণে এ ধরনের ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ সমূহ:
১: ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া
২: অতিরিক্ত ঘুমানোর ইচ্ছা বা ঘুম হওয়া
৩: সমালোচনার উপর একটু বেশী সেনসিটিভ হয়ে যাওয়া
৪: হাত পা ভারী ভারী অনুভব করা।
প্রিমেনস্ট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার (শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য)
সাধারণত মেয়েদের নিয়মিত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাবের পূর্ববর্তী অবস্থায় এ ধরনের ডিপ্রেশন হয়ে থাকে।
লক্ষণ সমূহ:
১: মুড সুইং
২: অ্যাংজাইটি
৩: খাদ্যের রুচির পরিবর্তন
৪: ঘুমের সমস্যা
৫: মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।
৬: প্রায় সব সময় ক্লান্ত অনুভব হওয়া।
৭ কোন বিষয় নিয়ে গভীর ভাবে মগ্ন থাকা।
মানুষ কেন ডিপ্রেশনে পড়ে বা থাকে??
একজন মানুষ বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশন আক্রান্ত হতে পারে। এর মধ্যে আমাদের আমাদের বাংলাদেশে পারিবারিক বা সামাজিক কারণে অনেকেই ডিপ্রেসড হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির মানুষজনদের মধ্যে বেশি ডিপ্রেশনের প্রবণতা দেখা যায়।
মানসিক আঘাত বা শারীরিক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও অনেক মানুষ ডিপ্রেশনের পরে।
আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরীরা তরুণ-তরুণীরা সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশনের পড়ে থাকে তাদের ফ্রন্টাল লোব বা ক্রিটিভ অংশ এটিকে নিষ্ক্রিয় রাখার কারণে। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের কিশোর কিশোরীএবংতরুণ-তরুণীদের মাঝে এই প্রবণতা অনেক বেশি। তারা দিনের একটা বড় সময় মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের সাথে সময় কাটাচ্ছে।
দীর্ঘদিন একটা আবেগ অনুভূতি হীন বস্তুর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার কারণে তারা তারা ডিপ্রেশন এ আক্রান্ত হচ্ছে এবং পাশাপাশি বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধুমাত্র এই মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ এবং নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপনের কারণে আমাদের তরুণ সমাজের বড় একটা অংশ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত আছে।
বিভিন্ন রকমের নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবনের কারণে মানুষ ডিপ্রেশনে যায়। যারা প্রতিনিয়ত ধূমপান করে তাদের একটা বড় অংশ ডিপ্রেশনে থাকে। মানুষ বিভিন্ন মানসিক বা শারীরিক কষ্ট দূর করার জন্য ধূমপান বা অন্যান্য মাদক জাতীয় দ্রব্য সেবন করে থাকে তারা ভাবে যে এটি তাদের কষ্টটাকে দূর করছে কিন্তু বাস্তবতা হল এটি তাদের কষ্টটা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টি বুঝার মত অবস্থা তাদের থাকে না।
ডিপ্রেশন এর প্রতিকার:
ডিপ্রেশনের বিভিন্ন স্টেজ থাকে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় আপনি ডিপ্রেশনের কোন স্টেজে আছেন সেই অনুযায়ী আপনার চিকিৎসা নিতে হবে। আমি কিছু প্রাথমিক ট্রিটমেন্টের কথা আলোচনা করছি।
১: সাইকোথেরাপি.
আপনি আপনার সমস্যাগুলো কোন একজন সাইকোলজিস্ট বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলবেন তিনি আপনাকে বিভিন্ন টাস্ক বা পরামর্শ দিবেন সেগুলোর মাধ্যমে আপনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
২: লাইট থেরাপি:
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং খুবই উপকারী। যারা মনে করছেন যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন তারা একটু বেশি সময় সূর্যের আলোতে কাটাবেন।সূর্যের আলো আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে। যেমন সকাল থেকে দুপুর বারোটা একটা পর্যন্ত এ সময়টিতে সূর্যের আলো আমাদের জন্য খুবই উপকারী।
৩: ব্যায়াম:
পুরুষদের জন্য(দৌড়ানো, পুশ আপ, পুল আপ, সাঁতার কাটা, সাইকেলিং, ওয়েট লিফটিং), মেয়েদের জন্য (হাটা, দড়ি লাফ, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা, সাইকেলিং,)
এই ব্যায়াম আপনাকে ডিপ্রেশন থেকে খুব সহজে বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি আপনার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।
৪: মেডিসিন:
একজন অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট আপনার ডিপ্রেশন এর মাত্রা অনুযায়ী আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দিতে পারে।
৫: প্রাণী পালন:
বিড়াল এবং খরগোশ এই দুটো প্রাণী মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে এবং মানুষের আবেগ অনুভূতির সাথে সহজেই মিশে যেতে পারে।যারা খুব বেশি ডিপ্রেশনে আছেন তারা বিড়াল বা খরগোশের কোন একটি বা দুটি একসাথে পালন করতে পারেন।
৬: খাদ্য :
বিভিন্ন রকমের খাবার আছে যেগুলো আপনাদের ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে তবে হ্যাঁ শুধু এই খাবারগুলো খেলেই আপনার ডিপ্রেশন কমে যাবে এরকমটা ভাবেন না।(ডালিম, আপেল, কিসমিস, আখরোট কলা, দুধ, সবুজ শাকসবজি, মাছ)
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার ৪০ মিনিট আগে ১০/১২ টা কাঠবাদাম খেতে পারেন।
৭: ঘুম:
একজন মানুষের দৈনিক ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। এবং রাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমোতে যাবেন। (ঘুম বিষয়ে আজকে বেশি কিছু বলব না আমার আগের আর্টিকেলটি তে ঘুম বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে)
৮: ড্রাগস:
অবশ্যই ধূমপান বা অন্যান্য যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্য আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে যদি আপনি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি চান এটার কোনো বিকল্প নেই।
৯: মেডিটেশন:( কিন্তু এটা না করাই উত্তম, )
অনেক সাইকলজিস্ট আপনাকে মেডিটেশনের কথা বলবেন এবং পদ্ধতিও দেখিয়ে দিবেন।
১০: ট্রাভেলিং:
আপনি এমন কোথাও থেকে ঘুরে আসুন যে জায়গাটা আপনার পছন্দের বা কোনো এক সময় সে জায়গাটিতে আপনার যেতে ইচ্ছে হয়েছিল।সাথে আপনার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে যেতে পারেন। (পরিবারের কেউ অথবা হাজব্যান্ড ওয়াইফ বা বন্ধুবান্ধব (ছেলে মেয়ে একসাথে না)।
১১: নামাজ (শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য)
আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন তাহলে নামাজের মাধ্যমে খুব সহজেই আপনি ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন।
0 মন্তব্যসমূহ