সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য কারিগর শেখ মুজিব-গুলশাহানা ঊর্মি।।BDNews.in


বিডি নিউজ ডেস্কঃ “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি….. আমি কী ভুলিতে পারি” আমাদের চেতনায় শাণিত, হৃদয়ের প্রতিটি অলিন্দে প্রকম্পিত হয় যে গান। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকলপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি বাঙালির মনে আলোড়ন জাগায় এই গান। এই গান সৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে বাঙালির আজন্ম স্বাধীনতা ও স্বাধীকারবোধের ইতিহাস।


বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালি-ই একমাত্র জাতি যে জাতি মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম এবং জীবন উৎসর্গ করেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। এটি শুধু মাত্র ‘শহীদ দিবস’ না; একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর তা সারা বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।


১৯৫২ সালের এই দিনে (বাংলা ৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯) বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহিদ হন। তাই এ দিনটি ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান এর কাছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো’র প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশসমূহে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।


১৯৪৭ সালে শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২০০ মাইল দূরত্বের ব্যবধানে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অমিল থাকার পরও দুইটি পৃথক ভূখণ্ডকে এক করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিলো বাংলা; অন্যদিকে মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষ কথা বলত উর্দূতে। সেই উর্দূকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু করে। কিন্তু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় দেশভাগের পরপরই কলকাতায় একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের পিছিয়ে পড়া ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এর নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেইসময় তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসে সরাসরি যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনে। গঠিত হয় ‘তমুদ্দিন মজলিস’ এরপর ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।


১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাব পাঠ করেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। তিনি বলেন “পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে প্রস্তাব করিতেছি যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের ভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেয়া হউক এবং জনসাধারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক। (সূত্রঃ বাংলা পিডিয়া) 


১৯৪৮ সালে এসে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথসভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন- শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাশেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহসহ অন্য নেতারা। এই সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। ওইদিন ভাষার দাবীতে প্রথম হরতাল পালিত হয় এবং এটিই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম হরতাল। এই হরতালের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওইদিন তিনি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন এবং গ্রেফতার হন। এটিই ছিল প্রথম কোন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতারের ঘটনা। শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেও আন্দোলনের গতি কমে না, আস্তে আস্তে কালের পরিক্রমায় তা গণআন্দোলনের রূপ নিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে শহর থেকে আন্দোলন সারা দেশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলো তরুণ ও ছাত্রসমাজ। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৯৪৯ সালে দুইবার গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হওয়ার পর মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। গ্রেফতার হওয়া অবস্থায় জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সাথে যোগাযোগ রেখে দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন এবং তিনি নিজে জেলে বসে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে অনশন পালনসহ নানা ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করতেন।


১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমির সাহিত্য সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “তারপর এলো ‘৫২ সেই রক্তাক্ত ফাল্গুন, তখন আমি জেলখানায়। জেল থেকে চিকিৎসার জন্য আমাকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে মানিক মিয়া নামক জনৈক পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের সাহায্যে সভাপতি ও সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। আমার সঙ্গে পরামর্শ করেই তাঁরা ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেই আমি ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করি অনশন ধর্মঘট। সেই অনশন ধর্মঘট আমি চালিয়ে যাই ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আমার সেদিনের বন্ধুরা হয়ত সেটা আজও মনে করতে পারবেন। আমাদের সেদিনের সেই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছিল। ২১শে’র রক্তরাঙা পথ বেয়েই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এবং স্বাধিকারের চেতনা ধীরে ধীরে এক দুর্বার গতি লাভ করে।”


‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন “শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন।”


ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন “১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেফতার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ‘৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।”


একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একাংশে অবস্থিত আমতলায় ছাত্রদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষকসহ উপাচার্য ১৪৪ ধারা না ভাঙার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে পুলিশ তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করে। এসময় ছাত্রীরাও রেহাই পায় না পুলিশের আক্রমণ থেকে। ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের দিকে পাল্টা ইট-পাটকেল ছোঁড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন রফিক উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত, আবদুস সালাম। অহিউল্লাহ নামে আট/নয় বছরের একজন কিশোরও সেদিন নিহত হন। (সূত্রঃ বাংলা পিডিয়া)


২৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়, যা পরে ১৯৬৩ সালে কংক্রিট দিয়ে নির্মিত হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত আকারে শুরু হওয়া আন্দোলন এর চরম প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।


ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, সংসদের দৈনন্দিন কার্যে বাংলার চালু প্রসঙ্গে আইনসভায় আবারও প্রতিবাদী বলিষ্ঠ কণ্ঠ শেখ মুজিব। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বীরোচিত ভূমিকা তাঁর। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে প্রভাত ফেরিতে মাওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেদিনও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।


পরিশেষে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলতে চাই- এই বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসহ সকল ইতিহাস ও অর্জনের নেপথ্য কারিগর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের পদপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণা।


লেখক: বিসিএস (তথ্য), সহকারী পরিচালক, প্রেস উইং, প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ