সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

শেষ বয়সের আশ্রয় - শিরিন শবনম।।BDNews.in


আবহাওয়া এবং ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এই বাংলাদেশের মানুষকে মানবিক, প্রেমিক এবং পরস্পরের প্রতি সহনশীল করে গড়ে তুলেছে। বেশিদিন আগের কথা নয়। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বাংলাদেশের কেউ বৃদ্ধাশ্রমে থাকার কথা ভাবেনি। কিন্তু এখন অহরহ এই বিষয়টি সামনে আসছে। বেশিরভাগ মানুষই শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার বিপক্ষে। বৃদ্ধ বাবা, মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে থাকার চিন্তা আমাদের বাঙালির সংবেদনশীল মনে আঘাত করে।

তবে এ বিষয়ে আমার মতামত:
১। যে সন্তানকে আমি আদর-যত্ন করে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তার নিজের জীবনের জন্য বড় করেছি, তার ঘাড়ে আমি কেনো নিজেকে বোঝা করব?
২। সন্তান তার নিজ ইচ্ছায় আমার জঠরে আসেনি। আমার জৈবিকতার প্রয়োজন এবং একটি সন্তানের মাঝে নিজের পূর্ণতা বা আনন্দ পাওয়ার উৎস হিসেবে সন্তানকে এনেছি। এখানে মমতা, মানবিকতার বাইরে সন্তানের কী দায় থাকে?
৩। আমি কি আমার বৃদ্ধকালে দেখভালের জন্য সন্তানকে এনেছি? যদি হয়, তার অধিকার কি আমার আছে? তাতে কি সন্তানের মত ছিল?
৪।‌ সন্তান প্রতিপালনের সামর্থ্যের বাইরে অপরিকল্পিতভাবে অগনিত সন্তান জন্ম দিয়ে কারো প্রতিই প্রয়োজনীয় যত্ন নেয়া যায় না। অনিয়ন্ত্রিত জন্মহারের গাদাগাদি করে বড় হওয়া এই সন্তানেরা কতটা মানবিক হতে পারবে? যদি না হতে পারে, যদি বাবা মায়ের প্রতি মমতাশীল না হয় তবে সে দায় কার?
৫। বাবা মা-ই বা কেনো নিজের সবটুকু দিয়ে দিবে সন্তানের জন্য? নিজের আয়ের কিছু অংশ হলেও নিজের বৃদ্ধ বয়সের জন্য রাখা দরকার যেন সন্তানের দ্বারস্থ না হতে হয়।
৬। অন্য ওয়ারিশরা ভাগ পেতে পারে ভেবে অনেকেই জীবদ্দশায় নিজের সমস্ত সম্পত্তি ভিটেমাটিসহ সন্তানের নামে লিখে দেয়। ফলাফল : সন্তানের স্পাউসের সাথে বনিবনা না হলে ভিটেহারা হয়। দোষটা কার তা নিয়ে বলছি না, এক্ষেত্রে বুদ্ধির ঘাটতিটা অস্বীকার করা যাবে না।
৭। সন্তানকে যদি সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে কোনো সন্তানই বাবা, মা'কে ফেলে দিতে পারে না। মানবিকতাবোধ বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই থাকে, একদম অমানুষ ছাড়া। বাবা-মা যদি শক্ত হতে পারে তবে সেই অমানুষ সন্তানকে প্রাত্যহিক জীবন থেকে দূরে রাখার মনোবল রাখতে পারলে নিজের সম্মানটুকু নিয়ে সন্তানের গলগ্রহ না হয়ে বেঁচে থাকা যায়।
৮। বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে সন্তান এবং তার স্পাউস দু'জনেই কর্মজীবী এবং দিন দিন বিশ্বস্ত গৃহকর্মীর দুস্প্রাপ্যতার সময়ে বৃদ্ধজীবনে বাবা-মাকে হয় সন্তানের বোঝা হতে হয় অথবা সাম কাইন্ড অফ মেইড হতে হয়। কোনোটিই কি কাঙ্খিত?
এসব সত্বেও সময়ের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনও বদলায়। আর বদলে যাওয়া প্রয়োজনের সাথে মনও বদলায়। অপাপবিদ্ধ মন নানা যাতনায় শ্রী হারায়। সময়ের গতি রুদ্ধ করার কোনো উপায় কারো নেই। সুযোগ থাকে শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তি চিন্তার বলয়ে নিজেকে নিজের আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করার।
সবার অবস্থান যেমন সমান নয়, সবার প্রয়োজনও তেমনি সমান নয়। সমান নয় সব মানুষের ব্যক্তি মন ও মানসিকতা। তবে কিছু বিষয় অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। বাবা-মা'কে সম্মান করা, তাদের প্রয়োজন দেখা, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা সব মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব অস্বীকার করা অমানবিক মনের পরিচয়।
যে সব সন্তান বাবা, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চায়, তারা সঠিক না বেঠিক, তা ন্যায় নাকি অন্যায়, তার ব্যবচ্ছেদ করে কিছুই ফল হয় না। সব সন্তান এক নয়। এক নয় তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা। সব বাবা-মাও (অপত্য স্নেহ, সন্তানের শুভকামনার জায়গাটি ছাড়া) আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শারীরিক মানসিক সুস্থতা... এমনসব বিবিধ কারণে সন্তানের প্রয়োজনে সমভাবে নিবেদিত হতে পারে না।
আমিও নিজের সন্তানের সংসারে বোঝা হতে চাই না। তারা আমাকে নিয়ে কী ভাববে সেটা তাদের নৈতিকতার প্রশ্ন। আমি যেভাবে, যে আদর্শে তাদের বড় করতে পেরেছি তার আলোকেই তা আমার কাছে ফিরে আসবে। যদি আমি আদর্শে, নৈতিকভাবে সুসন্তান হিসেবে তাদেরকে যোগ্য করে গড়তে পারি তবে আমি না চাইলেও আমার প্রয়োজন তারা ভাববে, তারা আমাকে ভালোবাসবে। আর যদি না পারি, তবে আমি চাইলেও তাদের ভালোবাসা পাব না।
আমি তাই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের সংসারে থাকার চিন্তা করি না। তারা তাদের জীবন নিয়ে সুখি হোক। তাদেরকে নিজের জৈবিক এবং অপত্য স্নেহের তাগিদে পৃথিবীতে এনেছি, বড় করেছি নিজের সবটুকু ঢেলে দিয়ে। এটা তাদের ঋণ নয় কোনোক্রমেই।
আমার শুধু অভিলাস, সমমনষ্ক, সমবয়স্ক ও সমরুচির মানুষদের সঙ্গে শেষ বয়সটা কাটানোর একটা উপায় যেন ততদিনে আমার এই অনুন্নত দেশে গড়ে ওঠে।
হবে তো! আমার শঙ্কা এটুকুই!
আমি অন্যরকম কিছুও ভাবি। আমার মনে হয় ৬০/৬৫ বছরের পর শত রোগশোক নিয়ে বেঁচে থাকা নিজের এবং অন্যদের - কারো জন্যই সুখের না। যদিও জন্ম, মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে ।
আমার এমনও স্বপ্ন হয়, যদি এমন বিধান থাকতো যে, রোগে-শোকে আক্রান্ত হয়ে বা অন্য কোনো কারণে বেঁচে থাকাকে ফলপ্রসূ মনে না করলে কোনো মানুষ যদি চায়, তবে সে ৬০/৬৫ পরবর্তী জীবনে স্বেচ্ছা মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারবে। মেডিকেল সাইন্সের প্রগতির এই যুগে সেই মৃত্যু হতে পারে ব্যথাহীন গভীর ঘুমে অচেতন অবস্থায়।
কিন্তু জানি, এমনটি কখনোই সম্ভব নয়। এতে মানবতা লঙ্ঘিত হয় যে! অথচ এই মানবতা লঙ্ঘনের চিন্তা ভুক্তভোগী মানুষটিকে চরম অমানবিক জীবন বয়ে চলতে বাধ্য করে।
সুস্থ শরীরে শেষ বয়সটা যাপনের জন্য সন্তানের গলগ্রহ হয়ে থাকার চেয়ে সমমনষ্ক, শিক্ষা রুচির মানুষের সাথে কাটানোটা অনেক স্বস্তির। সন্তানের সাথে তার অবসর সময়ে মধুর সময় কাটবে সেখানে গিয়ে অথবা সে এসে - এতে কোনো বাঁধা তো নেই। তাই বৃদ্ধাশ্রমের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে বৃদ্ধ বাবা-মা এবং কর্মভারে নূয়ে পড়া সন্তান উভয়ের জীবন যন্ত্রণাদগ্ধ না করে আধুনিক মনষ্কতা নিয়ে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য কীভাবে উন্নত, কমফোর্ট জীবনের ব্যবস্থা করা যায়, সরকার, সমাজ এবং শীর্ষস্থানীয় মানুষদের সেটাকেই ফোকাস দেয়া দরকার।

যে পারবে সে সন্তানের সাথেই থাকবে, যে পারবে সে বৃদ্ধা বাবা-মাকে সাথেই রাখবে তাতে তো কোনো বাঁধা নেই। কথা শুধু অসহায়দের নিয়ে - যাদের জন্য প্রয়োজনীয়।

সময়ের কল ক্যাচ করতে পারলে জীবনটাকে সহনীয় করে তোলা যায়।

নির্ভরশীলতা নয়, দায়িত্বের অবহেলা নয়। এইটুকুই পিতা-মাতা এবং সন্তানের উপলব্ধিতে থাকা যথেষ্ট নিজের প্রতি সুবিচার করে জীবনকে সহনীয় বা সুখী রাখার জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. বদলে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে নিজের চিন্তা চেতনায় বদল আসা অবশ্যম্ভাবি হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টা মানুষ যত বেশি বুঝতে পারবে নিজের মাঝে বদল আনতে পারবে। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানকেও দায়িত্ব বুঝতে পারার মতো শিক্ষায় বড় করতে হবে। কোনো কিছুই হয়তো পারফেক্ট হবে না তবে সহনীয় একটা জীবন দরকার শেষ বয়সে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনার মূল্যবান মতামত প্রকাশ করার জন্য আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।

      মুছুন