সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

কোরবানীর ঈদ ও খোকন - সৈয়দা রাশিদা বারী।।BDNews.in


খোকনের খাসিটার নাম মেড়া। মেড়ার বয়স এখন ছয় বৎসর। মেড়াটা এর মধ্যে কেমন করে যেন বাড়ির সকলের মন জয় করে ফেলেছে। আগে বাড়ির আনাচে কানাচে তাকাতেই দেখা যেত মা মরা এই মলিনমুখি মেড়াকে।

মেড়া এখন আর তেমনটি মলিন নেই। ওর গা টা এখন তেল চুকচুক। হরিণের মত সুন্দর চেহারা ওর। এখন ঘাস বা লতা পাতার লোভে তেমন বাইরেও যায় না। প্রায় সারাদিন ঘরের বারান্দায় সিঁড়ির ওপরে, সিঁড়ির নীচে অথবা উঠানের ডালিম গাছটার নীচে ঘুরে ফিরে কাটায়।

ওর পেট ভরানো এখন আর কারো কোন সমস্যা হয়ে নেই। কারণ তেমনটি হাভাতে ভাব ওর একদম কেটে গেছে। সে জন্য এখন আর কাউকে কোন বেগ পোহাতে হয় না।

দুবেলা দুমুঠো ভাত অথবা চাল—ডাল—গম এর যে কোন একটা হলেই সুন্দর দিন চলে। আর এসকলও কারো মেড়ার মুখের কাছে এগিয়ে ধরতে হয় না।। কারণ ওর মন চাইলে আপন আপনিই ঢুলে খেয়ে আসে। আর মন না চাইলে মুখের কাছে এগিয়ে দিলেও তাতে মুখ দেয় না। এ কারণেই খোকনের আম্মির খাসিটির প্রতি যেটুকু রাগ। 

আসলে মেড়া কিন্তু খোকনের আম্মিকে কম জ্বালায় না। চাউলের হাঁড়িটা সে যতই জব্দ মতো ঢাকে, দেখা যায় মেড়া ততই সহজে খুলে বসে তা। ওর এক মুখেই নাকি দুহাতের সমান শক্তি আর কায়দা জানা। কখনো কখনো মেড়ার ঐ খামখেয়ালী ঢেলে খাওয়াতে সংসারের বেশখানি ক্ষতিও হয়। যেজন্য এক দিন তো খোকনের আম্মি অধৈর্য বনে ওটাকে বাজারে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন, আর তাতেই খোকনের সে কি কান্না।

মেড়াকে খোকন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। বাড়ির আর কেউ বাসে না তাও নয়। প্রত্যেকেই যেন কেমন একটা অন্তরের টানেই মেড়াকে ভালবেসে ফেলেছে। তবে মাঝে মধ্যে মেড়ার অত্যাচার দোষেই খোকনের আম্মি যা একটু বিগড়ে বসেন। খোকনের আম্মি মেড়ার প্রতি যেমন বিরক্ত তেমন আবার গর্বিতও বটে। এই যেমন দেখা যায় কোন দিন মেড়া একটু চোখের আড়াল হলে উনি বার বার মেড়ার কথাই বলেন। মেড়া তার দৃষ্টির আড়াল হলে তার যেমন ফাঁকা লাগে।। বাড়িটতেও তেমনি শূন্যতা বিরাজ করে। আসলে তা মনে হয় বৈকি! গোটা বাড়িটা তো লোক শূন্য প্রায়। খোকন—নয়ন দুই ভাই দিনের অধিকাংশ সময় স্কুলে কাটায়। চাকুরি জীবন হিসেবে ওর আব্বুও খুব কম সময় বাড়িতে দাঁড়াতে পারেন। তাই মেড়াকে সংগে নিয়েই তো খোকনের আম্মির দিন কাটাতে হয়। 

আজ ক’দিন যেন মেড়াকে বেশী মোটা বলে মনে হচ্ছে। ওকে রাখা চলবে না। তাই বিক্রি করা দরকার। সে দিন কথাটা খোকনের আম্মিই প্রথম তুললেন।

হঁ্যা গো খাসিটা বিক্রি করলে কেমন হয়। ইস কি প্রচন্ড গরম পড়ছে, না জানি কবে চানা বন্ধ হয়ে বসে, তখন সব না গোল¬ায় যাবে। জানো ওটা বিক্রি করলে কম করে হলেও তিন হাজার টাকা হবে। দুলাল বলছিল তিন হাজার টাকা তো ফেলে দিলেও হবে। পাশেই খোকন কাঁচির সাহায্যে মাটিতে অঁাচড় কাটছিল। মায়ের কথা যেই না শুনেছে অমনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো ঃ তোমরা আমার মেড়াকে বেচবে তা বেচো, তবে আমিও সে দিন থেকে তোমাদের থেকে দূরে যাবো।

খোকনের মুখ চেপে ধরেন তার আম্মি ঃ ছি! ও আবার কি অলক্ষুণে কথা। তা কেন হবে, তুমি না আমার লক্ষ্মী সোনা। তোমার ছেড়ে কি আমি কখনো থাকতে পারি? তোমার মেড়াকে বেচে তোমারই তো গলার চেইন বানিয়ে দেব। দেখো তো এই চেইনটা সেই ছোট বেলায় তৈরী করে দিয়েছিলাম। কেমন হাল্কা আর পুরান হয়ে গেছে। খাসিটা বিক্রি করে একটা ভাল চেইন বানানো যাবে।

কর্কশ ভাষায় খোকন জবাব দিলো ঃ বেশ আমার মেড়ারও বেচে দরকার নেই, চেইনেরও আমার দরকার নেই। চেইন আমি গলায় পরবো না। কথা কটা শোনার পর ওর আম্মি আর খোকনের উপর জোর দিয়ে কোন কথাই বাড়ায় নি।

ছোট ছেলে এই খোকনকে উনি অত্যাধিক ভালবাসেন কিনা? তাই ওর ছোট মনে কোন ব্যাথ্যা দিতে চান না তিনি।

এরই মধ্যে দু’মাস পেরিয়ে গেছে। খোকনের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হয়ে গেছে। কোরবানী ঈদের টানা ছুটি হবে। গোটা স্কুলটা খুশিতে গম গম করছে। ক্লাসে স্যার এসে বললে¬ন ঃ তোমরা ধর্ম বই থেকে কোরবানীর ঈদ সম্পর্কে পড়েছ তাই না? এক সংগে সবার কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো ঃ জী স্যার। এবার শিক্ষক বলে¬ন ঃ বলতো কেন এই ঈদ? কেউ বলতে পারলো না। খোকন উঠে দাঁড়ালো এবং বললো  স্যার হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর ছেলে ইসমাইল (আঃ) কে আল¬াহ কোরবানী করার আদেশ দিয়েছিলেন——সে থেকেই এই ঈদ। কিন্তু স্যার কেন এই আদেশ হলো আর কেনই বা তার ছেলেও তা মেনে নিলেন, এ গল্পটি আপনি যদি বুঝিয়ে দিতেন স্যার, তাহলে খুব ভাল হতো।

খোকন থেমে গেল অন্য আর ছাত্র ছাত্রীরও গল্পটি শুনার জন্য অনুরোধ জানালো। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে এই আগ্রহ দেখে স্যারের মন খুশিতে ভরে উঠলো। তিনি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে গল্পটা বললে¬ন। ছেলে মেয়েরাও একমনে শুনলো।

পরিশেষে স্যার বললে¬ন ঃ জানো ইব্রাহীম (আঃ) এর সব চেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাঈল, এই ইসমাঈলকে ইব্রাহীম (আঃ) মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আদর করতেন। আর সে জন্যই কিন্তু কোরবানী দেয়ার পশুটিও হতে হবে আদরের আর ভালবাসার। খোকন বললে¬া ঃ স্যার আদরের আর ভালবাসার কেমন করে হয়। তা বুঝিয়ে দিন।

দিচ্ছি। ধরো কোন পশু যদি নিজের হাতে লালন পালন করা যায়। তবে সে পশুটির প্রতি আর অন্য পশুগুলোর চেয়ে ঠিকই দরদ বেশী থাকে। থাকে না? ছাত্র—ছাত্রীগুলো উত্তর করলো ঃ জী স্যার, থাকে।

হঁ্যা, এ জন্যেই নিজের হাতে প্রতি পালন করে সে পশুটির কোরবানী দেয়া সব চাইতে শ্রেয়। তার মানে যাতে কোরবানীর পশুটি মহব্বতের, দরদের আর ভালবাসার হয়ে থাকে।

শোন, কোরবানী দিলেই কোরবানী নয়। এ ত্যাগ মহব্বতের এ ত্যাগ বেদনার, এ ত্যাগ মহিমার। যে ত্যাগে মহব্বত নাই। সে ত্যাগে বেদনারও স্পর্শ নাই। যদি বেদনা না থাকে সে ত্যাগ কোন ত্যাগই নয়। তাইতো ইব্রাহীমের মতই মহিয়ান হয়ে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, তিনি যেমন ত্যাগের মহিমায় আল¬¬াহর নামে শিশু পুত্রকে কোরবানী দিতে তৈরী হয়েছিলেন, আমাদের তেমনই মহব্বতের সংগে দরদের সংগে ত্যাগি হতে হবে।

আর মনে রেখো, যে নিজেকে সম্পূর্ণ রিক্ত করে নিজের সর্বস্বকে বিলিয়ে দিতে না পারে সে কখনো ত্যাগী নয়। তাইতো তেমনটি মন তৈরী করে তবেই না  কোরবানী দিয়েছি বলে গর্ব বোধ করা যাবে। কিন্তু দেখো আমাদের ক’জনে তা করে? সবই তো দেখি মান সম্মান রাখতে অন্যদের সংগে পাল¬¬া দিয়ে কোরবানী দিয়ে থাকে।

স্যারের কথাগুলো শুনতে শুনতে খোকনের মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে মেড়ার কথা। এবার খোকন বলে।

স্যার  কোরবানী করলে সে পশুর কি হয়। তাতে কি পশুর কোন লাভ আছে? খোকনের এই আকস্মিক প্রশ্ন শুনে স্যার না হেসে পারলেন না।

মনে করো সে পশুর সেটা ভাগ্য। আল¬¬ার নামে যে পশু কোরবানী হয়। তা ভাল হবে বৈ কি! তাছাড়া ধরো হালাল পশুর রূপ নিয়ে যাদের জন্ম হয়েছে এ সংসারে, তাদের তো একদিন না একদিন ছুরির তলে যেতেই হবে। তাই মরতে যখন হয়ই তখন আল¬াহর ওয়াস্তে কোরবানীর নামে মরা তো পশুটির ভাগ্য।  কোরবানী পশুর আত্মা আল¬¬ার কাছে জিম্মা থাকে। ওদের আত্মার একটি আলাদা মর্যাদা তো আছেই।

স্যারের কথায় খোকনের মন আজ ভরে গেছে। তার একমাত্র প্রিয় যে মেড়া, তাকেই নিয়ে ছিল তার একটা বিরাট চিন্তা, মেড়ার মঙ্গল কি করে হবে। খোকনের এ চিন্তার আজ যেন থৈ মিলেছে। এতদিনে আজ যেন সন্ধানের সঠিক পথ মিলেছে। এতদিনে আজ যেন সন্ধানের সঠিক পথ মিলেছে। এই গর্ব আনন্দে খোকনের কচি মন থেকে সব ভুল হয়ে গেছে। তাই ঈদের দিনে তার বন্ধু বান্ধবরা যাতে আসে, একথাও আর বলা হলো না। ক্লাস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি মুখো চলছে সে।

আম্মি আজ তোমাকে একটা কথা বলবো, বলো শুনবে?

উ! এই যে পাগল ছেলে ফিরেছে এতক্ষণে। বলি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আগে কাপড় ছাড়, বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাও, তারপর যা বলার বল। সব শুনবো।

রাতে খোকন নয়ন ওর আব্বু তিনজনে খেতে বসেছে আম্মি পরিবেশন করছেন। আম্মি বললেন, বুঝলে গো, খোকার কথা শুনেছ কিছু?

তোমার খোকার আবার নতুন কি কথা শুনবো?

খোকা তোমাকে কোরবানীর ছাগল কিনতে নিষেধ করেছে। ওর ছাগলটাই নিতে বলছে।

ও! এই কথা? এ তো সুখবর, আমি ভেবেছিলাম আবার নতুন কোন বায়না হয়তো। বায়নার তো শেষ নেই।

জানো তাই যদি হয় তাহলে সব চেয়ে ভালো হবে। এমন হাতে পুষেই তো কোরবানী দেয়ার নিয়ম। তাহলে এতদিনে এবারের কোরবানীটা আমাদের সত্যি সত্যি স্বার্থক হবে।

তা আবার ভালো করে প¬¬ান ট্যালান টিক করো। নইলে পরে আবার তোমার ছেলে যদি বেঁকে বসে, তখন দেখা যাবে ছেলের পিছ পিছ তুমিও বেঁকে বসেছ। পরিমাণে যত ঝামেলার ভার একা আমার উপর আসবে।

না আব্বু আমার কথা আর নড়চড় হবে না। এতদিন কষ্ট করে পুষেপুষে পরের ঘরে কখনোই দিতে যাবো না। তার চাইতে মেড়া আমাদের হয়েই আল¬¬াহর কাছে যাক।

খোকনের কচি মুখে এমন একটি চমৎকার কথা শুনে তার আব্বু খুশীই হলেন। ঃ বেশ বাবা, তাই যাক। আমাদেরই তাতে ভালো হবে।

ঈদের দিন সবার মন আনন্দে গদ গদ হয়ে আছে। খাসিটার দু'চোখ কেমন জানি জল ছলছল করছে। সামনে থালা ভরা ভাত চাউল পড়ে আছে। ও আজ কিছুই খাচ্ছে না। খোকনের আম্মির চাউলের হাঁড়ির দিকেও যাচ্ছে না। বাড়িটাও কেমন যেন আনন্দ বেদনায় গুম হয়ে আছে। খোকন মহা উল¬¬াসে বার বার ঈদগাহ আর বাড়িটা একাকার করছে।

এই তো আর একটু পরেই নামাজ। শেষ হলে মেড়াকে কোরবানীর ছুরি তলে যেতে হবে। ত্যাগের মহীমায় খোকন আজ সব ভুলে গেছে। ছলো ছলো মায়া চোখে মেড়া তার খোকনকে জনমের মত দেখে নিচ্ছে। এই শেষ দেখা। আর দেখবে না ও।

যখন কোরবানীর ছুরি তলে দেয়ার জন্য মেড়াকে হাত পা বাঁধা হলো। তখন ওখানে খোকনের আর কোন—ই ভূমিকা থাকলো না। আজ আর মেড়ার প্রতি খোকনের কোন হাত নেই। বেদনা ওর বুকের মধ্যে ধরাস করে উঠলো। দুটো চোখ আনন্দ—বেদনার পানিতে ঝপসা হয়ে এলো। ও দেখলো মৌলভী সাহেব চকচক ছুরি হাতে মেড়াকে আক্রমণ করার উপক্রমে.......।

অজান্তে বাড়ির মধ্যে ছুটি গিয়ে আম্মিকে জড়িয়ে ধরলো খোকন।

আম্মি মেড়াকে ছুরি দিয়ে কাটছে।

কাটুক তুমি দুঃখ পেওনা। এতে দুঃখ পেতে নেই। মেড়াতো আল¬¬াহর কাছে আমাদের জন্যই জমা থাকবে।

এক ফালি চাঁদের হাসি বাঁকা ঠেঁাটে। খোকনের আম্মি শাড়ীর অঁাচলে ছেলের চোখের জল মুছে ছেলেকে আরো গভীর স্নেহে বুকে চেপে ধরলেন। তারপর আস্তে করে তারও নিজের গোপন পানিটুকু মুছে ফেললেন। স্নেহভরা মায়ের বুকে মুখ লুকোতে খোকনের মনে ভেসে উঠলো স্যারের মুখ। মায়ের মুখের সান্ত্বনার বাণী ভেদ করেই যেন খোকনের কানে ভেসে এলো স্যারের কথা।

মনে রেখো, যে নিজেকে সম্পূর্ণ রিক্ত করে নিজের স্বর্বস্বকে বিলিয়ে দিতে না পারে সে কখনো ত্যাগী নয়।

সে কখনো ত্যাগী নয়, সে কখনো .........।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ