দাদীকে লেখা নন্দিনীর খোলা চিঠি-শিরিন শবনম। |
প্রিয় দাদী,
কী লিখি তোমায়!
আমি জানি শিশু আমার, বালিকা আমার হৃদয়ের সকল পরত তোমার ছিল জানা। তখন আমার সকল খুশি, সকল কান্না, সকল অভিমান তুমি তোমার হাতের তালুতে থাকা রেখার মত চিনতে পারতে। উপলব্ধি করতে পারতে। তাই কখনো আমার বলতে হয়নি, শীত লাগছে, গরম লাগছে, খিদে পেয়েছে। ইলেকট্রিক ফ্যানহীন সময়ে তুমি সারারাত আমায় তালপাখায় বাতাস দিতে। ঘুমের মধ্যেও কেমন করে যেন তোমার হাত থামত না। তন্দ্রায় হাতটা একটু ধীর হয়ে আসলে তখনি আবার জোর বাতাস দিয়ে সেটা পুষিয়ে নিতে। দুধমাখা ভাত নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে না দিলে তোমার পেট ভরত না। খেতাম আমি, পেট ভরতো তোমার।
কিন্তু তুমি বেশি দিন রইলে না। আমার দশ বছর বয়সে তুমি আকাশের তারা হয়ে গেলে। আমি তখন বুঝিনি কী হারিয়েছি। এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিয়েছি, এ চলে যাওয়া জীবনের এক খেলা। এটা মানতে হয়। কিন্তু দাদী, মানব মনের রহস্যময় খেলা কে কবে বুঝেছে?
একদিন যৌবন এসেছে। প্রেমময় এক সঙ্গী পাশে দাঁড়িয়েছে। আপন মনে রাজকন্যা আমি, জগতের হালচাল বুঝি না। ভেবেছি, এই-ই বুঝি সব। ভালবাসা থাকলে বুঝি আর কিছু লাগে না। তাকে নিয়ে জন্মশহর ছেড়ে পাড়ি দিলাম বহুদূর দেশে। ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান এল আমার কোলে। তাকে নিয়ে মগ্ন রইলাম। নিজেকে বুঝি না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে এক আমি, তোমার আদরের 'রাজকন্যা' তার অস্তিত্ব বেমালুম ভুলে থাকলাম।
একদিন সময়ের গতিতে মেয়ের নিজের জীবনের জন্য উড়ালের সময় এল।
আমার এখন অবসর। নিজের দিকে তাকালাম। এ কে? একে তো চিনি না। নিষ্ঠুর সময় আলগোছে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। বড় বেশি চোখে পরে অপ্রাপ্তিগুলো। দাদী, দূর আকাশের তারা হয়ে তুমি কী বড় বড় ফোঁটায় চোখের পানি ফেলছ? আমার হৃদয়ের একুল ওকুল ভাসিয়ে বন্যা আসছে কেনো?
আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। এখন বুঝি, জীবনের প্রয়োজনের দৌড়, দৌড়, দৌড়ের তাড়নায় এতদিন কিছু বুঝি নাই। এখন অবসরে চোখ মেলে দেখি জীবনটা একটা তামাশা হয়ে যাচ্ছে। এখন মন চায় মনের সঙ্গ। সমমনষ্ক, সমবোধের সঙ্গ। শুধু ভালবাসা বড় পানসে দাদী! সকল প্রয়োজনের শেষে মন যখন শুধু নিজেকে চায় আমার আকাশের সীমানায় তখন সাঁঝ নামে চর্তুদিক আঁধার করে।
দিনের পর দিন চার দেয়ালে আমার বড় অরুচি। আমার মন মুক্ত আকাশ চায়। চায় সমুদ্রে অবগাহন।
ছোটবেলায় যখন আমাদের পদ্মপুকুর এপার ওপার সাঁতরে পার হয়েছি, তুমি পাড়ে বসে উৎসাহ দিতে। রঙিন ঘুড়ি কিনে দিতে। এখন আমার মন নিজেই ঘুড়ি। মন চায় মুক্ত আকাশে উড়ান। কিন্তু আকাশ বড় সীমাবদ্ধ। সভ্য মানুষ আমি। বড় সীমাবদ্ধ এ জীবন। সীমাবদ্ধ এক জীবন অসীমে উড়ার মন নিয়ে আমি তড়পিয়ে মরি নিজের মনের একলা বিজন ঘরে।
কিছু ভাললাগে না। কিছু ভাললাগছে না। এই জীবন, এই শহর, এই সময়। কোন রুট নেই আমার। ভাবনার অলিগলি সব এসে মিশে কৃষ্ণচূড়া ছাওয়া এক রাজপথে, একটিই পথ। আমার মনের আকাশের পথ। নিজ হৃদয়ের এক বায়বীয় অস্তিত্ব শুধু অনুভবে পাই যার কোনো আকার নেই। চারদিকটা বড় একঘেঁয়ে আর বর্ণহীন। কুয়োর জল তোলা আর ফেলা নিয়ে দিন কাটে, রাত যায়। সব আছে, সব আছে। মানুষ, বিত্ত, নিরাপত্তা - সব আছে। তবু মন রক্তাক্ত, শরাহত অন্য এক নীল বেদনায়।
এক মহাবিশ্বে যেন একা এক আমি। ভুতগ্রস্ত একা এক আমি! সাঝ নেই, ঊষা নেই, দিনরাতের কোনো তারতম্য নেই। যখনি নিজের দিকে তাকাই দেখি চোখের কোণ ভিজে আছে। কেনো? এ উত্তর আমার জানা নেই।
শোনো দাদী, আমি যখন শহরে যাই, বাস ধরতে হয়। পথে খুব সুন্দর একটা শহরতলী পথ পড়ে। এত সুন্দর যে দেখলে মনটা উদাস হয়ে যায়। ঠিক তখনি তোমার জন্য ভীষণ প্রাণ কাঁদে। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে ধারা নামে। স্কার্ফের আড়ালে ঢেকে রাখি মানুষের কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি। শহরতলীর সেই পথটা যখন শেষ হয়ে যায় তখন আবার ঠিক হয়ে যায়। এটা প্রতিবার হয়। কেনো হয় জানি না।
দাদী, তুমি কি সব দেখতে পাচ্ছ? তুমি কি তোমার রাজকন্যার পাশে এসে একটু বসবে? আমি একটু মন ভরে মুক্ত আকাশে উড়ি! সমুদ্রের নোনা জলে মন ভরে সাঁতার কাটি!
...... ইতি, তোমার নন্দিনী
6 মন্তব্যসমূহ
প্রিয় নন্দিনী তোমার খোলা চিঠি পৌঁছে গেছে ইথারে ভেসে।
উত্তরমুছুনআপনার মূল্যবান মতামত প্রকাশ করার জন্য আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুছুনউপলব্ধমান হৃদয়ের এ এক কাব্য কথা! তবে মনে হয় জীবনের সকল দায় শোধ হয়ে গেলে এ শূন্যতা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল হৃদয়ে বাজে। প্রকাশের ধরণটা শুধু সবার জানা নেই অথবা ভিন্ন হয়!
উত্তরমুছুনআপনার মূল্যবান মতামত প্রকাশ করার জন্য আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুছুনখুব ভালো লেগেছে লেখাটি পড়ে।
উত্তরমুছুনআপনার মূল্যবান মতামত প্রকাশ করার জন্য আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুছুন