কিন্তু ডেভিড পপেনো (David Popenoe) পরিবারের সংজ্ঞাকে আরও একটু বর্ধিত করেছেন । তিনি শুধু স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের সন্তানকেই একটি পরিবারের অংশ না বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর ঘনিষ্ঠভাবে নির্ভরশীল সদস্যকে একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ধরেছেন । তার মতে, “Family is a group of ‘kin’ who live together and function as a co-operative unit for economic or other purposes.” অর্থাৎ পরিবার হলো এমন কিছু আত্মীয় বা কুটুম্বের গ্রুপ যারা একসাথে বসবাস করে এবং অর্থনৈতিক বা অন্যান্য উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে সহযোগিতামূলক একক হিসেবে কাজ করে ।
মূলত একই পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মিয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে । তাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক (ভাই-বোন, সন্তান ও পিতামাতা) এবং মজবুত আইনি সম্পর্ক (বিবাহের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী) থাকে ।
ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হচ্ছে সমাজের ভিত্তিমূল। পরিবারিক সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনেক দিক নির্দেশনা রয়েছে কোরআন ও হাদিসে । আমাদের রাসুল সাঃ বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম” (ইবনে মাজাহ, তিরমিজি) হিন্দু ধর্ম মতে, পরিবার হচ্ছে একটি মন্দিরের মতো, যেখানে দেবতা স্বরূপ বাবা-মা বাস করে। প্রতিটি পরিবারই একজন মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার প্রথম বিদ্যাপীঠ। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে একটি শিশু তার পরিবার থেকেই সামাজিক জীব হিসেবে তৈরি হয়।
সামাজিক আচার-আচরণ, পরিবারের সবার প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, হাসি-আনন্দ ও দু:খ ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে দৃঢ় মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার গুণাবলি শিখে থাকে। যে কারণে পরিবারকে সমাজের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে পরিবারের কোন বিকল্প নেই। চার অক্ষরের এই “পরিবার” শব্দটির অর্থ অসীম। সামাজিক ঐক্য এবং পারস্পারিক নির্ভরতা পরিবারের মূলমন্ত্র। পরিবার সাধারণ তিন ধরণের হয়ে থাকে । একক পরিবার, যৌথ পরিবার এবং বর্ধিত পরিবার । স্বামী, স্ত্রী ও কেবলমাত্র তাদের সন্তান নিয়ে গঠিত হয় একক পরিবার । স্বামী, স্ত্রী ও তার সন্তান ছাড়াও যখন পরিবারের কর্তার বাবা-মা, ভাই-বোন ও তাদের সন্তানসহ একসাথে থাকে তখন তা যৌথ পরিবার । আর যদি চাচা,ফুফু এবং দাদা-দাদিসহ আরও একাধিক আত্মীয় একসাথে থাকে তবে সেটি বর্ধিত পরিবার ।
বাঙালী সমাজের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী বর্ধিত বা একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্ব এখন আর নাই । কোনও কোনও জায়গায় যৌথ পরিবার থাকলেও নানা কারণে পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত ভেঙ্গে যাচ্ছে । ক্রমাগত তৈরি হচ্ছে একক পরিবার । শহর কি আর গ্রাম কি সব সমাজে একই অবস্থা । গ্রামে এখনও কিছুটা যৌথ পরিবার আছে, তবে সেটিও ভাঙ্গনের পর্যায়ে। শহরে এখন অবশ্য যৌথ পরিবার খুব একটা নেই । অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক নানা কারণে সন্তানরা এখন বাবা-মার সাথে যৌথ পরিবারে থাকতে চায় না । কেন থাকতে চায় না তার কিছু বাস্তব কারণ নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি-
১) বউ-শাশুড়ির চিরন্তন দ্বন্দ্ব
আমি এ দেশের প্রতিটি নারীকে শ্রদ্ধার আসনে রেখেই বলতে চাই, এই ভাঙ্গনটি ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্বের কারণে । যে নারীটি ছেলের বউ হয়ে আসছেন তিনি তাঁর শাশুড়িকে নিজের মায়ের দৃষ্টিতে দেখতে পারছেন না। আবার অন্যদিকে শাশুড়িও ছেলের বউকে নিজের মেয়ের দৃষ্টিতে দেখতে পারছেন না। যার পরিণতি হচ্ছে বউ শাশুড়ির চিরন্তন দ্বন্দ্ব । এই চিরন্তন দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্য বাবা মার সাথে যৌথ পরিবারে থাকতে চায় না সন্তানেরা । Times of India তে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম সেখানে বাবা-মার সাথে প্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবাহিত সন্তান থাকতে না চাওয়ার একটা উল্লেখযোগ্য কারণ দেখানো হয়েছে, কারণটি হচ্ছে “বাবা-মা তাদের সঙ্গীকে (স্পাউজকে) সম্মান না দেখানো । তাকে আপন করে না নেয়া ”
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়ে জামাইকে অনেক সম্মান করা হলেও ছেলেদের বউকে কিন্তু সেভাবে সম্মান দেখানো হয় না । একটা মেয়ে তার বাবার বাড়িতে যে সম্মান পায় শশুরবাড়িতে সেইরকম মর্যাদা পায় কিনা সন্দেহ! এরই প্রেক্ষিতে আজ সবাই যেন স্বামীর বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দৌড়ে নেমে পড়েছে ।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে বাবা-মা ছোটবেলা থেকে নিজেদের সন্তানের সাথে যেরকম কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকে ঠিক একই আচরণ যেন করতে থাকে ছেলের বউয়ের সাথেও । নিজের সন্তানের কাছে তা স্বাভাবিক মনে হলেও ছেলের বউয়ের কাছে কিন্তু তা অস্বাভাবিক মনে হয় । কারণ সে ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন আবহে বেড়ে উঠা মানুষ । শাশুড়ি বা শশুরের অযাচিত কর্তৃত্ব অনেক সময় বাড়াবাড়ি ঠেকে ছেলের বউয়ের কাছে ।
বাংলার চিরাচরিত বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ অতীতের একান্নবর্তী ও যৌথ পরিবারেও ছিল। বউ-শাশুড়ির এই যুদ্ধকে উপজীব্য করে এদেশে অনেক চলচ্চিত্র ও নাটক অসংখ্য দর্শকের বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে। শুধু চলচিত্র কেন কলকাতার অধিকাংশ সিরিয়ালে এখনও দেখানো হয় ছেলের বউ নয়তো শাশুড়ির নোংরা কুটচাল । বউ শাশুড়ির দ্বন্দ্বে ঘি ঢালার নানা কৌশল শেখানো হয় যেন ।
তবে কলকাতার একটা অসাধারণ চলচ্চিত্র রয়েছে “মুখার্জী দার বউ” । যেখানে সুন্দরভাবে চিত্রায়ন করা হয়েছে বউ শাশুড়ির সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ । একে অপরকে দুচক্ষে দেখতে না পারা বউ শাশুড়ি কীভাবে নিজেদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিয়ে একে অপরের পাশে দাড়িয়ে পরম বন্ধু হয়ে উঠতে পারে তা এখানে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে । আমার মনে হয় বাঙ্গালী প্রতিটি শাশুড়ি ও ছেলের বউয়ের এই মুভি দেখে বউ-শাশুড়ি একসাথে বন্ধু হয়ে বসবাসের পাঠ নেয়া উচিৎ ।
শাশুড়ি ও পুত্রবধূর সম্পর্ক আসলে একটা চরম নিয়তি। এটাকে এড়ানোর সুযোগ নেই । তাই এই সম্পর্ককে তিক্ত হতে না দিয়ে কার্যকর ও মজবুত করে তোলার চেষ্টা করতে হবে উভয়কেই । পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য শাশুড়ি ও বউয়ের এই সম্পর্ক সুন্দর করার চেষ্টা করা উচিৎ । একে অপরকে ভালবাসতে হবে । বউ শাশুড়িকে শ্রদ্ধা করবে এবং শাশুড়ি ছেলের বউকে স্নেহ করবে; তবেই না তাদের সম্পর্ক সুন্দর হয়ে উঠবে ।
২) সন্তানের স্বার্থপরতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা
বিয়ে করার পর নিজের সন্তান হলেই স্বাবলম্বী ছেলে তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে একক পরিবারের স্বপ্ন দেখা শুরু করে । বাবা-মাকে বাদ দিয়ে শুধু নিজের একান্ত নিজের একটা জগত চায় । বাবা মা, ভাই-বোনসহ যৌথ পরিবারের পিছনে অর্থ খরচ করাটাকে অনর্থক খরচ ভাবতে শুরু করে । যৌথ পরিবারে নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় রোধের জন্য অনেকে আলাদাভাবে একক পরিবার গড়তে আগ্রহী হয়ে উঠে ।
বাবা-মার আয় রোজগারে বড় হওয়া সন্তানেরা যখন নিজেরা আয় করতে শুরু করে তখন বয়স্ক বাবা-মাকে দূরে না ঠেলে তাদেরকে আগলে জীবন যাপন করা ভুলে যায় । হিন্দি ‘বাগবান’ মুভিতে এক বয়স্ক দম্পতির গল্প উঠে এসেছে । অমিতাভ বচ্চন এবং হেমা মালিনী এই দম্পতির চরিত্রে অভিনয় করেছেন । ভারতীয় উপমহাদেশের সন্তানদের স্বার্থপরতা চিত্রায়ন করা হয়েছে এই বাগবান মুভিতে । চাকুরী থেকে বাবা অবসরে যাবার পর বয়স্ক বাবা-মার জীবনের পট কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা দেখানো হয়েছে সোনালি পর্দায় । অবসরে যাবার পর বাবা ভেবেছি্রদাচার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে সুখে থাকবেন । কিন্তু অবসরে যাবার পর দেখতে পান চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো গেছে । সন্তানদের কাছে বাবা-মা নিগৃহত হতে থাকে ক্রমাগত । মুভির শেষের দিকে বাবা অমিতাভ বচ্চন বলেন “সন্তানেরা বাবা-মাকে উপরে উঠার সিঁড়ি না ভেবে তাদেরকে গাছের শেকড়ের মতো ভাবা উচিৎ । যে শেকড় তাদেরকে সব সময়ই জীবন যাপনের রসদ জোগাবে।” সন্তানদের বাবা-মাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতাকে সামনে রেখে একই মুভিতে অমিতাভ বচ্চন বলেছেন, “যে বাবা মা সন্তানদের প্রথম কদম ফেলতে সাহায্য করে সেই একই সন্তান কেন সেই বাবা মাকে শেষ কদম ফেলতে সহায়তা করে না? ”
কিছু ভাল ও মানবিক গুণসম্পন্ন স্ত্রী ছাড়া অধিকাংশই চায় না স্বামী তার উপার্জিত অর্থ যৌথ পরিবারে থেকে বেশী খরচ করুক । অসুস্থ বাবা-মার জন্য অতিরিক্ত খরচ ও তাদের সেবা শুশ্রূষা করার জন্য সময় বের করতে নারাজ যেন সবাই! তাই আলাদা হবার প্রচেষ্টা যেন থাকে সবার মাঝে । একবার এক ইংরেজি আর্টিকেলে পড়েছিলাম,“Women marry to take care of husbands and have children. Until these tasks are fulfilled, other relationships hold little importance.”
সবাইকে পিছনে ফেলে একা একা নিজে বড় হতে চাওয়ার এই প্রবণতা আমাদের ছাড়তে হবে । সবাইকে হতে হবে মানবিক । নিজের স্ত্রী ও সন্তান ছাড়া বাবা-মার পিছনে অর্থ ব্যয়টাকে অপচয় না ভেবে নিজের কর্তব্য ভাবতে হবে সব সময়।
৩) অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি
শিল্প বিপ্লবের আগে মানুষ খুব একটা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতো না । মানুষ কৃষিভিত্তিক সমাজে বাস করতো । আগে পরিবারের প্রত্যেকে কোনও না কোনভাবে একে অপরের ওপর যেন নির্ভরশীল ছিল। এখন সেই নির্ভরতা ক্মে গেছে । ছেলে স্বয়ংসম্পূর্ণ; আগের মতো আর যৌথ পরিবারের কৃষক নয়, চাকুরী বা ব্যবসা করছে । ছেলের বউও হয়তো কোনও পেশায় যুক্ত; যুক্ত না থাকলেও আগের মতো শশুর-শাশুড়ির উপর নির্ভরশীল নয়। বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ এড়াতে আলাদা হয়ে একক পরিবার গঠনই শ্রেয় মনে করছে। স্বনির্ভরতা ও আত্ননির্ভরশীলতা মানুষকে যেমন স্বচ্ছ্বল ও স্বাবলম্বী করে তুলছে, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আত্মিক ও সামাজিক বন্ধনও কমিয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, বাংলাদেশের আধুনিক সামাজ ব্যবস্থার প্রসার, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সংখ্যানুপাতিক হারে জীবিকার তারতম্য ঘটতে থাকায় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে । জীবন ও জীবিকার তাগিদেই আগের মতো ভাই-ভাই এক সঙ্গে বসবাস করেন না। বাবা-মার সাথে গ্রামে বসবাস করতে পারছেন না ছেলেরা । অর্থ আয়ের তাগিদে পেশাগত কারণে বিচ্ছিন্ন হতে হচ্ছে । তাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ভেঙ্গে একক পরিবারের ভাগ হয়ে যাচ্ছে পুরো সমাজ ।
৪) অতি মাত্রায় স্বাধীনচেতা মনোভাব
সবাই নিজের মতো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় । বাসায় আজকে মাছ না মাংস রান্না হবে তার জন্য বউ শাশুড়ির আদেশ শুনতে বা পরামর্শ নিতে নারাজ । মাছ হোক, মাংস হোক, ভর্তা হোক, কিংবা ভাজি হোক সে একাই সিদ্ধান্ত নিতে চায় । অন্যদিকে ছেলেও বাবার সাথে কোনও বিষয়ে পরামর্শ করতে চায় না । সব সময় বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তার মন আগ্রহী নয় । নিজে আয় করে সংসার চালায় তাইও সিদ্ধান্ত নিতে নিজেই আগ্রহী । অন্যের সিন্ধান্তে নিজের জীবন পরিচালনা করতে সবাই নারাজ । সন্তান ও তাদের সঙ্গীদের নিজেদের ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনচেতা মনোভাব অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মার সাথে যৌথ পরিবারে থাকতে বাঁধার সৃষ্টি করে । সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘মানুষ সামাজিক জীব’ । সেই মানুষেরই নিজের বাবা-মার সাথে বাস করার মানসিকতা না থাকলে আর কিসের সামাজিক জীব?
সবাই সবার চাওয়া-পাওয়াকে মূল্যায়ন করা উচিৎ । কেউ কারও উপর নিজের সিদ্ধান্ত না চাপিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা খুব জরুরী । একান্ত ভুল সিদ্ধান্ত না হলে বাবা-মার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রদানের ক্ষমতা হরণ না করে বরং তা সন্তানদের মেনে নিয়ে পরিবারে বাবা-মার অবস্থানটাকে মজবুত করা খুব জরুরী । বাবা-মাহীন পরিবার আসলে দক্ষ মাঝি বিহীন পানসি নৌকা ছাড়া আর কিছুই নয় ।
৫) ছেলে সন্তানের কম অনুভূতি ও কম আবেগ প্রবণতা
সব পরিবারেই সাধারণত বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর সংসারে চলে যায় । রয়ে যায় শুধু ছেলে সন্তানেরা । তাও যদি সে ছেলে সন্তান নিজের এলাকায় চাকুরী ব্যবসা বা কৃষিভিত্তিক কোনও কাজে জড়িত থাকে । সামাজিক নানা কারণে বাবা-মা মেয়ে জামাইয়ের বাসায় থাকতে চায় না বা থাকতে পারে না । বাবা-মা জীবনের পরম পরিণতিই হচ্ছে হয় একা বাস করতে হবে; নয়তো ছেলে ও ছেলের বউয়ের সাথে থাকতে হবে । মন থেকে অনেক চাইলেও যেন মেয়ে সন্তানের সাথে থাকার সুযোগ হয় না বাঙ্গালী বাবা-মাদের ।
কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে ছেলেরা মেয়েদের মতো ততটা অবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ নয় । বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করলেও মেয়েদের মতো বাবা-মার জন্য তাদের মন খুব একটা কাঁদে না ।
যদিও ছেলের বিয়ের পর ছেলেদের অবেগহীন হওয়ার দায় তার সঙ্গীর উপর এসে যায় । বাবা-মাকে বলতে চাই সঙ্গীকে দোষ দেয়ার আগে আপনাদের ছেলে ও মেয়েদের বিবাহিত জীবনের আগের কাহিনী একটু ঘেঁটে দেখবেন । ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের মতো বাবা-মার জন্য এক বুক আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে বসে থাকে না । কারও কারও ভালোবাসা থাকলেও তার প্রকাশভঙ্গিমা একটা মেয়ের মতো কখনও হয় না । একটা পরিবারের যদি দুই ভাই-বোন বাইরে পড়াশুনা করতে চলে যায় তাহলে ছাত্র জীবনেই দেখা যায় ছেলে তার বাবা-মার সাথে দেখা করার জন্য বছরে যত বার বাসায় আসে মেয়ে তার চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ পরিমাণ বেশি বার বাসায় আসে বাবা-মার সাথে দেখা করার জন্য ।
বিজ্ঞানের গবেষণায় এটা প্রমানিত হয়েছে যে ছেলরা মেয়েদের চেয়ে কম আবেগহীন হয়ে থাকে । অন্যের দুঃখ, অনুভূতি তাদেরকে কম নাড়া দেয় । আর ছেলে সন্তানের এই কম আবেগহীনতাই ছেলে সন্তান ও তার সঙ্গী কর্তৃক পিতামাতা থেকে দূরে থাকার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়, আত্মকেন্দ্রিক হতে রসদ যোগায় ।
আমি ছাত্র জীবনে সম্ভবত প্রথম আলোতে এক নিঃসঙ্গ বাবার কষ্টের কাহিনীর উপর একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম –‘যেখানে এক বাবা তার দুই ছেলেকে অনেক যত্ন করে মানুষ করেছেন । তাদের শিক্ষিত করেছেন । একজন দেশের বাইরে চলে গেছে এবং আর একজন দেশে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে । কিন্তু দুই ছেলের কেউ বাবার তেমন খোঁজ নেয় না । তিনি বাসায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন; কারণ তার স্ত্রীও কয়েক বছর আগে মারা গেছেন । তিনি প্রতিবেশী অনেক বাবার মেয়েদেরকে বাবার খোঁজ খবর নিতে দেখেন । তখন তিনি অনেক কষ্টে আক্ষেপ করে বলেন ‘পৃথিবীতে যেন এমন কোন বাবা না থাকে যার মেয়ে সন্তান নাই ।’ ”
আমি ছেলেদেরকে উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যে বাবা-মা ত্রিশটি বছর আপনাকে নিঃস্বার্থভাবে লালন-পালন করলো, নিজে না খেয়ে আপনাকে খাইয়েছে, নিজে না পরে আপনাকে পরিয়েছে; সেই বাবা মাকে একটা স্ত্রী যে আপনার জীবনে মাত্র দুই-তিন বছর বা আর কিছু বছর আগে এসেছে তার কথায় দূরে ঠেলে দিবেন?
আবার ছেলের বউদের উদ্দেশ্যেও বলতে চাই । আপনি তো আপনার বাবা মাকে অনেক ভালবাসেন । তাদের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারেন । তাদের জন্য আপনি নানা দায়িত্ব পালন করছেন । নিজে চাকুরী করলে স্বামীকে বলে বা না বলে গোপনে বাবা মার চাহিদা পূরণ করছেন, আর চাকুরী না করলে স্বামীর সংসার থেকেই অল্প কিছু দিচ্ছেন বাবা-মাকে । তাহলে সেই একই দায়িত্ব পালনে আপনি আপনার স্বামীকে বাঁধা দিচ্ছেন কেন? শশুর শাশুড়িকে বাবা-মার মতো ভাল না বাসতে পারুন আপনার স্বামীকে সন্তান হিসাবে তার দায়িত্ব পালনে বাঁধা দিবেন না । আপনার বাবা-মার যেমন আপনি ছাড়া কেউ নাই তেমন তো আপনার স্বামীর বাবা-মারও সে ছাড়া কেউ নাই বা থাকলেও পর্যাপ্ত না ।
৬) জেনারেশন গ্যাপ
জেনারেশন গ্যাপের কারণে বাবা-মার সাথে মতের বা চিন্তাধারার মিল না হওয়ায় অনেক সময় বিরাট সমস্যা দেখা দেয় । বাবা-মার কাছে যা সঠিক মনে হয় ছেলে বা ছেলের বউয়ের কাছে তা সঠিক মনে নাও হতে পারে । যেমন ছেলে তার পুত্র, স্ত্রী- কন্যাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে ফেলে । যেটা হয়তো বাবা-মার কাছে মনে হয় এটা ঠিক না এর ফলে পুত্র ও কন্যা সন্তান বখে যেতে পারে। নতুন সন্তান জন্ম নিলে ছেলের বউয়ের কাছে মনে হয় বাবুর গায়ে জনসন লোসন বা অলিভ ওয়েল মাখানো সঠিক কাজ । আর শাশুড়ির কাছে মনে হয় খাঁটি সরিষার তেল ডলে ডলে নাতির গায়ে ম্যাসেজ করাটা সঠিক কাজ । দুজনের মাঝে এই নিয়ে একটা মন কষাকষি তৈরি হতে পারে ।
২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে Firuz Nawer Aahir Fianncial express এ প্রকাশিত তার আর্টিকেল “Managing Parents-children generation gap” এ উল্লেখ করেন,
“The generation gap is anchored in the constantly changing nature of human civilization. It leads to miscommunication and a lack of bonding between parents and their kids।”
অর্থাৎ প্রজন্মের ব্যবধান মানব সভ্যতার ক্রমাগত পরিবর্তিত প্রকৃতিকে আরও এগিয়ে নিচ্ছে। এর ফলে পিতামাতা এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এবং বন্ধনের অভাব তৈরি হচ্ছে ।
তিনি আরও বলেন,
“Older and younger individuals to understand each other because of their disparities in experiences, views, habits and actions….. The primary challenge arises due to a mental gap in thinking style and current trends”
অর্থাৎ “অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যাস এবং কর্মে বৈষম্যের কারণে বয়স্ক এবং অল্প বয়স্ক ব্যক্তিদের একে অপরকে বোঝার ক্ষেত্রে তারতম্য তৈরি হয়... প্রাথমিক চ্যালেঞ্জটি সৃষ্টি হয় চিন্তাভাবনার শৈলী এবং বর্তমান প্রবণতার ব্যাপারে মানসিক ব্যবধানের কারণে ।”
জেনারেশন গ্যাপ এর কারণে এরকম ছোট খাট নানা বিষয়ে মতের অমিলের কারণে সন্তানেরা বাবা-মার সাথে থাকতে আগ্রহী হয় না । এ ছাড়াও দেখা যায় যে সন্তানদের মাঝে সহনশীলতার বেশ অভাব । যার কারণে বাবা মার সাথে না থেকে একক পরিবার গড়ে তোলে ।
বাবা-মা নিজের সন্তানের সাথে যেমন অধিক মাত্রায় কর্তৃত্বমূলক আচরণ দেখাবেন না তেমনি সন্তানও বাবা-মার গৃহীত সিন্ধান্ত সম্মানে অগ্রাহ্য করে যাবে না । উভয়কে উভয়ের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখাতে হবে । বাবা-মাদের ভাবতে হবে সন্তান একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা, তাই তার বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হতে পারে । আবার অন্যদিকে সন্তানদেরকে ধৈর্য সহকারে বাবা-মার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে ।
৭) সন্তানকে সম্পদ এবং বাবা-মাকে আপদ মনে করা
আমাদের সমাজে প্রতিটি পরিবার সব রেখে নিজের সন্তানদের পিছনে বিনিয়োগ করায় ব্যস্ত । সন্তান যেন এই কারণে লালন-পালন করছে যে বড় হলে সে তাদের দেখে রাখবে, বংশের মুখ উজ্জল করবে । নিজের সমস্ত উপার্জন কাজে লাগিয়ে সন্তানকে মানুষ করার প্রতিযোগিতায় যেন নেমে গেছে সবাই । প্রতিবেশী বা অন্যান্যদের সন্তানের চেয়ে আমার সন্তান কিভাবে বেশি ভাল রেজাল্ট করবে? কিভাবে ভাল জায়গায় চান্স পাবে? কিভাবে সে প্রতিষ্ঠিত হবে? এই চিন্তা সবাইকে এমন আচ্ছন্ন করে রাখে যে বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরর দিকে একটু নজর দেয়ার সময় যেন কারও নেই । বিষয়টা যেন এমন বাবা-মার পিছনে এখন বিনিয়োগ করে কি লাভ? সে তো এখন সম্পূর্ণ মাত্রায় আনপ্রোডাক্টিভ ।
কিন্তু আমি প্রতিটি ছেলে-মেয়েকে বলতে চাই যে সন্তানকে আপনি প্রোডাক্টিভ ভেবে শুধু তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন, বাবা-মার দিকে খেয়াল রাখছেন না; মনে রাখবেন আপনার সন্তানের কাছে আপনার বাবা-মার মতো আপনিও কালের পরিক্রমায় একদিন আনপ্রোডাক্টিভ হয়ে যাবেন । তাই সন্তানের পাশাপাশি বাবা-মার প্রতিও আমাদের সুনজর দেয়া উচিৎ ।
বাবা মাকে নিজের পরিবারের অংশ ভাবতে হবে। তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে আগলে রাখতে হবে নিজের সন্তানের মতো । তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে হবে আমাদের । আমরা ভুলে গেলে চলবে না আল্লাহর রাসুল বলেছেন, “মুমিনদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক পূর্ণ ঈমানের অধিকারী, যে অধিক সুন্দর চরিত্রের অধিকারী এবং পারিবারের সাথে কমল আচরণকারী ।” ( তিরমিজি, নাসায়ি) । আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে কোরআনে একটি দোয়া শিখিয়েছেন “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস ছাগিরা” অর্থাৎ “হে প্রভু আমাদের বাবা মাকে সে অবস্থায় রাখুন তারা আমদের ছোট বেলায় আমাদেরকে যেভাবে রেখেছিল ।”
আমাদের শৈশবে বাবা-মা আমাদেরকে যেভাবে রেখেছিলেন এই দোয়া শুধু আল্লাহ আমাদেরকে মুখে মুখে আওড়াতে বলেছেন এমন না; এটাকে বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য নানাভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় । অর্থাৎ বাবা মা আমাদেরকে শৈশবে যেভাবে রেখেছিলেন, সন্তান হিসাবে আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে সেভাবে আদরে-আহলাদে রাখা । সব স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও বিভেদ ভুলে আমাদের উচিৎ আমাদের জীবনে এই দোয়ার বাস্তবায়ন করা । শুধু সৃষ্টিকর্তার আদেশ বলে না সামাজিক জীবন হিসেবে পিতামাতার প্রতি দায়িত্ববোধ এবং মানবিক মূল্যবোধের কারণেও আমাদের বাবা-মার পাশে থাকা উচিৎ শক্ত অবলম্বন হয়ে ।
লেখকঃ শারমিন আকতার
0 মন্তব্যসমূহ