সর্বশেষ খবর

10/recent/ticker-posts

২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।।BDNews.in


বিডি নিউজ ডেস্কঃ একুশে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে বাংলা ভাষায় কথা বলা সকল মানুষের জন্য একটি গৌরবময় দিন।এই দিনটি বাংলা ভাষা ব্যাবহারকারী জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। উক্ত এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সুপরিচিত। ২১ ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়ার পেছনেও এক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে। 

সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে মানুষ নিজের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। কখনো সে অঙ্গভঙ্গি করেছে, কখনো বা ছবি এঁকেছে, আবার কখনো মুখ থেকে নানান রকম আওয়াজ করেছে। যুগ যুগ ধরে মনের ভাব প্রকাশের জন্য মানুষের মুখনিঃসৃত এই বিভিন্ন ধরনের বিক্ষিপ্ত আওয়াজের সমষ্টিগত সংগঠিত পূর্ণাঙ্গ রূপ হল ভাষা।

বিশ্বজুড়ে নানা অঞ্চল ভেদে মানুষের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে শত সহস্ত্র ভাষা এবং সেই ভাষার অবলম্বনকারী নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠী। তেমনি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সন্তানেরা তাদের জন্মলগ্ন থেকে ঐতিহ্যগতভাবে যে নির্দিষ্ট ভাষাটির মাধ্যমে নিজেদের ভাব প্রকাশ করতে শেখে, সেটিই হল তাদের মাতৃভাষা। কোন গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তির মাতৃভাষা তার কাছে শুধুমাত্রই একটি সামান্য ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়।

সেই নির্দিষ্ট ভাষাটির সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে ইতিহাসের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক সংস্কৃতি তথা মহান আবেগ। মনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা ভাবকে ছুঁয়ে প্রকাশ করে যে ভাষা, তার সাথে যে আবেগ জড়িয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। মানুষের সেই আবেগকে, প্রত্যেকের মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস তথা মহান সংস্কৃতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটকে গোড়া থেকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেরও আগে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনো। সেই সময়ে ভারতবর্ষ থেকে সদ্য বিভক্ত হয়ে যাওয়া পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান রূপে পরিচিত ছিল আজকের গৌরবময় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের প্রধান তথা বৃহত্তর অংশের জনগোষ্ঠী মূলত উর্দু ভাষাভাষী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানুষদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে বহু প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আবেগ। কোন ভাষার বিস্তৃতির সাথে সেই ভাষাগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও আবেগেরও বিস্তৃতি ঘটে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর থেকেই বাংলা ভাষার ওপর জোর জুলুম তীব্রতর হতে থাকে। এর প্রতিবাদে তীব্র হয় ভাষা আন্দোলনও।

১৯৫২ তে তা চরম আকার নেয়। ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত তরুণ ছাত্র ছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে কয়েকটি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। এদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, সালাম, শফিউল, বরকত সহ অনেকেই।বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই মহান দিনটিকে স্মরণ করেই ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতিসংঘ এই দিনে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

ইতিহাসে যতদূর জানা যায় তা হল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন কানাডার ভেঙ্কুভারে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তাদের সার্বিক উদ্যোগে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন।

এরপর আরও নানা সুধীজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন ওঠাপড়ার শেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই অধিবেশনেই মোট ১৮৮টি দেশের সমর্থন সহযোগে প্রস্তাবটি পাশ হলে তার পরের বছর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে।

এরপরে ২০১০ সালের একুশে অক্টোবর সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে জাতিপুঞ্জ স্বয়ং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। তার পরের বছর মে মাসে জাতিপুঞ্জের ১১৩ সদস্য বিশিষ্ট তথ্য বিষয়ক কমিটিতে উক্ত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা লাভ করে।

নিজের মাতৃভাষা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে পরম আদরের এবং হয়তো সবচেয়ে কাছের একটি বিষয়। সেই ভাষার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত একটি দিনকে মানুষ পরম উৎসাহের সাথে পালন করে থাকে। এই দিনটিতে পৃথিবীজুড়ে মানুষ মেতে ওঠে নিজের ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসের গৌরবময় চর্চায়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে ভাষার এমন ব্যাপক উদযাপন আর কোন দিন দেখা যায় না। এ যেন এক ভাষা মহোৎসব।

ভাষাভিত্তিক এই উদযাপনের সম্ভবত সবচেয়ে নির্মল রূপটি দেখা যায় বাংলাদেশে। নিজের ভাষাকে ভালোবেসে এতোখানি আত্মোৎসর্গের ইতিহাস আর কোন জাতির আছে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে স্মরণ করে করে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়। দেশের রাষ্ট্রপতি প্রধান মন্ত্রী তথা বড় বড় বিদ্বজ্জনেরা এই দিনটিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে বাংলাদেশের ইতিহাসের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।

শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরার উদ্দেশ্যে দেশজুড়ে এই দিনে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরাও এই দিনটিতে বাংলাদেশের সমবেত হয়ে থাকেন। টেলিভিশন ও রেডিও জুড়ে ভাষা আন্দোলনের মহিমা প্রচারিত হতে থাকে।

লেখকঃ মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ